সিভিক ভলেন্টিয়ার্সদের (Civic Volunteers) জন্য ‘সুখবর’। পঞ্চায়েত ভোটের ঠিক আগে ‘সুখবর’ই বটে। তা না হলে ‘বিনা পরীক্ষা’য় এবার সিভিক ভলেন্টিয়ার্সদের (Civic Volunteers) কনস্টেবল করে দেওয়ার ভাবনা রাজ্য সরকারের মাথায় আসবে কী করে? আমাদের মুখ্যমন্ত্রী তো আর বাঙালিদের ‘ভালো’ ছাড়া ‘মন্দ’ চান না! সুতরাং ‘সুখবর’ ছাড়া এ রাজ্যে তো আর খবরই হয় না।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় (Mamata Banerjee) লড়াকু নেত্রী, এ বিষয়ে কারও কোনও সন্দেহ নেই। বিরোধী নেত্রী হিসেবে বাংলার বাম আমলে তিনি যা লড়াই করেছিলেন, তা এখন ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে লেখা আছে বা থাকবে। কিন্তু বিরোধী থেকে তিনি যখন শাসক হলেন, এবং সেই শাসকের বিরুদ্ধেই যখন বিরোধী তৈরি হয়ে গেল – তখন আরও একটা লড়াইয়ে নামলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। কিন্তু তাঁর এই ক্ষমতা ধরে রাখার লড়াই আদৌ বাংলা কিংবা ভারতের রাজনীতির ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে কি, এখন সেটাই হচ্ছে সবথেকে বড় প্রশ্ন।
কথাতেই আছে, ‘‘যে যায় লঙ্কায় সেই হয় রাবণ।’’ বাংলার মানুষ বড় আশা করে সিপিএমকে তাড়িয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে রাজ্যের সিংহাসনে বসিয়ছিলেন। তারপর প্রথম ৫ বছর দেখতে দেখতেই কেটে গিয়েছিল। পরের ৫ বছর কিছু প্রশ্ন উঠেছিল। কিন্তু মানুষ ভেবেছিলেন – এতটুকু চলবে। কিন্তু তার পরের ৫ বছরের ২ বছরেই তিনি এমন খেলা দেখাতে শুরু করলেন – যা দেখে বাংলার মানুষকে ভাবতে হচ্ছে, রাজ্যটা আস্ত থাকবে তো?
বাম আমলে মমতা ব্যানার্জীরই প্রধান এবং প্রথম অভিযোগ ছিল, রাজ্যকে দেনায় ডুবিয়েছেন জ্যোতি, বুদ্ধ বিমানরা। তখন কত দেনা ছিল পশ্চিমবঙ্গের? ১ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকার কাছাকাছি। মোট ৩৪ বছরে পশ্চিমবঙ্গ চালাতে এই টাকাটা ধার করেছিলেন সিপিএম নেতারা। কিন্তু বিরোধীদের দাবি, গত ১২ বছরেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় পশ্চিমবঙ্গকে চালাতে দেনা করেছেন এর ৩ গুণ। অর্থাৎ এখন পশ্চিমবঙ্গের মোট দেনার পরিমাণ সাড়ে ৫ লাখ কোটি টাকার ওপর।
বাম আমলে শিক্ষার রাজনীতিকরণ করতে গিয়ে প্যারা টিচার নিয়োগের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। পিছন পথে পার্টি আর টাকার জোরে এমন কিছু লোকজনকে শিক্ষক বানিয়ে দেওয়া – যাঁরা শিক্ষকতার পরীক্ষায় পাশ না করে পড়ুয়াদের শিক্ষা দেবেন। এতে পার্টির যেমন ফলোয়ার বাড়বে, তেমনই পার্টি ফান্ডে টাকা আসবে। বাড়তি ফাও হিসেবে একজন শিক্ষককে যে বেতন দিতে হয় তার চার আনা দিলেই কাজ হবে। সবদিক দিয়ে লাভই লাভ।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বাম আমলকেও টেক্কা দিলেন। প্যারা টিচার নিয়োগ তো রইলই, সঙ্গে শুরু হল পার্থ-মানিক-তাপস-কুন্তলদের লাখ লাখ টাকার বিনিময়ে চাকরি দেওয়ার খেলা। মানে গাছেরও খাব, তলারও কুড়োব। সবটাই আমার। কিন্তু হজম হল কি? সবই তো ধরা পড়ে গেল। কিন্তু এরপরেও রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মানতে নারাজ। শিক্ষা নিতে নারাজ।
কিন্তু গল্পটা ওখানেই শেষ হয়ে গেলে ভালো হত। কিন্তু ওই যে কুণাল ঘোষের মতো নেতারা বলেন, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় হলেন সবথেকে বড় বামপন্থী। সুতরাং বামপন্থীদের সবথেকে বড়গুণটা তো তাঁর কাছেই আশা করা যায়। তাই প্যারা টিচারের এক্কেবারে নকল সিভিক ভলেন্টিয়ার হয়েছিল। শিক্ষা ব্যবস্থার পাশাপাশি পুলিশ প্রশাসনটাকেও যোগ্যতার পরীক্ষার বাইরে ছুড়ে ফেলা হয়েছিল। কিন্তু ভেতো বাঙালি তাও সহ্য করে নিয়েছিল। হাজার হোক, বাংলার বেকার ছেলে-মেয়েগুলোরই তো চাকরি হয়েছে। অতএব ঝামেলা করে লাভ কি?
কিন্তু হিসেবে কাঁচা ভেতো বাঙালি এটা বুঝলো না, সিভিক ভলেন্টিয়ারের বেতন কত দেওয়া হচ্ছে আর পার্টি ফান্ডেই বা কত নেওয়া হয়েছে। সেই জায়গায় একজন যোগ্য যুবক কনস্টেবল হলে কত বেতন পেতেন। এভাবে গ্রেড সি কিংবা ডি’র লোক নিয়ে পশ্চিমবঙ্গের শিক্ষা আর পুলিশ দফতর চালালে রাজ্যের ধারের বোঝা হয়তো একটু কমে, কিন্তু যোগ্যদের প্রতি সঠিক বিচার হয় কি? যোগ্যদের কি তাহলে এরাজ্যে কাজের জন্য অযোগ্য ধরে নিতে হবে? তাঁরা পেট চালাবে কী করে? আর এই প্যারা টিচার এবং সিভিক ভলেন্টিয়ারের কাজ দিতে গিয়ে যে টাকাটা নেওয়া হয় – সেটা যায় কার পকেটে?
কিন্তু এগিয়ে বাংলার নেত্রী এখানেই থেমে থাকতে নারাজ। খবরে প্রকাশ, তিনি না কি এবার চাইছেন, ওসব পরীক্ষা-টরিক্ষা দিয়ে লাভ নেই, বরং এবার সিভিক ভলেন্টিয়ারদেরই কনস্টেবল বানিয়ে দেওয়া হোক। সত্যিই তো, শিক্ষকের পরীক্ষা নিয়ে লাভটা কী হল? সবই তো ভুঁয়ো? পরীক্ষা নিয়েও যদি ভুঁয়োরাই চান্স পায়, তাহলে না পরীক্ষা নিয়েই ব্যাপারটা হোক। পরীক্ষার নামে জালিয়াতি করলে একটু বেশি বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে। লোকে হৈ-হল্লা করছে।
তবে সিভিক ভলেন্টিয়ার থেকে কনস্টেবলের স্টেবল মাইনা আর চাকরি নিতে গেলে ৩টি শর্ত মানতে হবে। ১। ভালো কাজ করতে হবে? ২। যেখানে পদ খালি রয়েছে সেখানেই এই ব্যাপারটা হবে। আর ৩। উচ্চপদস্থ আধিকারিকদের ছাড়পত্র থাকতে হবে। অবাক কান্ড, ৩টি শর্তের মধ্যেই কোথাও যেন চিচিং ফাঁকের গল্প দেখা যাচ্ছে।
ভালো কাজের মানে কি? পার্টির সু‘নজরে থাকা? যেখানে খালি পদ রয়েছে সেখানেই হবে মানে যখন ইচ্ছা যেখানে খুশি যতজন খুশি নেওয়া? আর উচ্চপদস্থ আধিকারিকদের ছাড়পত্র মানে কি শাসকদলের নেতা-নেত্রীদের ছাড়পত্র? তাহলেই সিভিক ভলেন্টিয়ার থেকে কনস্টেবলের চাকরি পাকা!
এরপরেও আমরা ভেতো বাঙালিরা দুপুরের এক টুকরো মাছ-ভাত কিংবা চারপিস চিকেন অথবা দু পিস মাটন খেয়ে পান চিবোতে চিবোতে বলব, বাহ দিদি বাহ, কী দারুণ কী দারুণ। গোটা দুনিয়া পিছিয়ে আর বাংলা এগিয়ে! সত্যিই আমাদের মুখ্যমন্ত্রী যা পারেন তা কেউ পারে না।