তথাগত সিংহ
একজন বেরোতেই আরেকজনকে ঢোকানোর ব্যবস্থা করা হয়েছিল। কিন্তু অবশেষে দু’জনেই রাজ্যপুলিশের মুখে ‘ঝামাঘষে’ হাসিমুখে বেরিয়ে এলেন। প্রথমজন আইএসএফ নেতা নওশাদ সিদ্দিকী (Nausad Siddiki)। এবং অন্যজন কংগ্রেস নেতা তথা আইনজীবী কৌস্তভ বাগচী (Kaustav Bagchi)। দু’জনেই শনিবার ‘পুলিশের হাত থেকে’ মুক্তি পেলেন। এবং গল্পের শেষে যেটা দাঁড়াল – রাজ্যের তৃণমূল সরকারের আরও একবার মুখ পুড়ল।
কথা হচ্ছে, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের (Mamata Banerjee) সরকারের জন্য এই ‘মুখ পুড়ল’ কথাটা নতুন কিছু নয়। আদালতে গত ১বছরে এই সরকারের এতবার ‘মুখ পুড়েছে’ যে ‘মুখ পোড়া হনুমান’ও লজ্জা পাবে। হিন্দিতে একটা কথা আছে। ‘আ বয়েল, মুঝে মার’ – গোদা বাংলায় অনেকটা সেই ‘বাঁশ তুমি কেন ঝাড়ে’র মতো ব্যাপার আর কি – কথায় কথায় পুলিশ দিয়ে বিরোধীদের তুলে নিয়ে গিয়ে আদালতে মুখ পুড়ছে রাজ্য সরকারের। যাঁদের তুলে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, তাঁদের বিরুদ্ধে তেমন কোনও মামলাই দাঁড় করাতে পারছে না পুলিশ। আদালত তাই জামিনও দিয়ে দিচ্ছে।
সত্যি কথা বলতে, এতে পুলিশের দোষ কিছু নেই বললেই চলে। পুলিশ আর করবেটা কি! ওপর মহলের যদি নির্দেশ থাকে তাহলে বিনা ডিএ’তেই তাঁদের রাত বিরেতে ছুটতে হচ্ছে। না হলে কোথায় পোস্টিং দেবে কেউ জানে না। ফলে নির্দেশ না মেনে উপায় নেই। কিন্তু প্রশ্নটা উঠছে অন্য জায়গায়। প্রশ্ন হচ্ছে, পশ্চিমবঙ্গের তৃণমূল সরকারটা শেষ পর্যন্ত অসহিষ্ণুতার (Intolerance) পরিচয় দিচ্ছে না তো? মোদী সরকারের শুরুর দিকে এই তৃণমূলই কিন্তু অসহিষ্ণুতার অভিযোগ তুলে আক্রমণ শানাত। সে নিয়ে জাতীয় রাজনীতিতে কম হৈ হল্লা হয় নি। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়েরও কেউ সমালোচনা করলেই তাঁকে পুলিশ তুলে নিয়ে যাচ্ছে। যেমনটা এই কৌস্তভ বাগচীকে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। কিন্তু দিনের শেষে তৃণমূল হাতে কি পেল?
আশ্চর্যের বিষয় তৃণমূলের মুখপাত্র খোদ কুণাল ঘোষ (Kunal Ghosh) কৌস্তভ বাগচীর গ্রেফতারি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। বিরোধিতা করেছেন। স্পষ্ট বলেছেন, ‘‘কাজটা ভুল হল।’’ এর ব্যাখ্যায় কুণাল বলেছন, এতে বিরোধিরা আরও বেশি আক্রমণের হাতিয়ার পাবে। তৃণমূল সরকারের বিরুদ্ধে সমালোচেকার আঙুল তোলার সুযোগ পাবে। কুণাল ঘোষ যেটা বুঝতে পারছেন, তৃণমূল নেত্রী কি সেটা বুঝতে পারছেন না? না কি তিনি সেটা বুঝেও বুঝছেন না?
সন্দেহ নেই সাগরদিঘি (Sagardighi) হাতছাড়া হওয়ার পর থেকেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মন খুব একটা ভালো নেই। রাগের মাথায় তিনি এমন হুঁশিয়ারিও দিয়ে বসে আছেন, ভবিষ্যতে তিনি একাই বিরোধীদের ‘চোখে সর্ষের ফুল’ দেখিয়ে ছাড়বেন। এর আগে একাই তিনি বাম সাম্রাজ্যের সঙ্গে লড়াই করেছেন। ৩৪ বছরের সিপিএমকে বাংলার ক্ষমতা থেকে টেনে নামিয়েছেন। হয়তো ১২ বছর পর এখনও যে তিনি সেই রকম একটা লড়াই দেওয়ার ক্ষমতা রাখেন, সেটাই হয়তো বলতে চেয়েছেন। কিন্তু ১২ আগের পশ্চিমবঙ্গ আর এখনকার পশ্চিমবঙ্গ কি এক? ১২ বছর আগের রাজনৈতিক পরিস্থিতি আর এখনকার রাজনৈতিক পরিস্থিতি কি এক? ১২ বছর আগের মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আর এখনকার মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কি এক?
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ১২ বছর আগে বিরোধী নেত্রী হিসেবে যা করেছেন, এখন সেটাই করতে গেলে কিন্তু সবথেকে বড়ভুল হবে। ১২ ধরে বাংলার মানুষ বুঝে গিয়েছেন, মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কি করতে পারেন আর কি করতে পারেন না। বাংলার মানুষ কি এখন বুঝে গিয়েছেন, সিঙ্গুরে টাটাদের তাড়ানো যত সহজ ছিল, বাংলায় নতুন শিল্প নিয়ে আসা কিন্তু ততই কঠিন। তাছাড়া পরপর ৩বার ক্ষমতায় এলে প্রতিষ্ঠান বিরোধী হাওয়া উঠবেই। মানুষের মধ্যে না পাওয়ার হতাশা বাড়বেই। তা সে যতই তাঁদের পকেটে ৫০০ টাকা আর ফ্রি-তে দিন কাটানোর ব্যবস্থা করে দেওয়া হোক। সিঙ্গুরে টাটাদের তাড়িয়ে বাংলার মানুষ নিশ্চয় ফ্রি-র মালে জীবন কাটানোর কথা ভেবে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে পশ্চিমবঙ্গের ক্ষমতায় আনেন নি। সুতরাং সমালোচনা তো হবেই। তা বলে পুলিশ দিয়ে তুলে নিয়ে গেলে কিন্তু মানুষের ক্ষোভ আরও বাড়বে বই কমবে না।
রইল গিয়ে কৌস্তভ বাগচীর কথা। কৌস্তভ বাগচী মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে ব্যক্তিগত আক্রমণ করে ভুল করেছেন। কিন্তু এই ব্যক্তিগত আক্রমণটা করেছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে দেখেই। সাগরদিঘি বিধানসভা হাতছাড়া হয়ে যাওয়ার কষ্ট নিয়ে মিডিয়ার সামনে কথা বলতে গিয়ে যেভাবে মুখ্যমন্ত্রী অধীর চৌধুরির ব্যক্তিগত জীবনের প্রসঙ্গ টেনে এনেছিলেন, তাতে কংগ্রেসীদের রাগ হওয়ারই কথা। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যদি সেদিন অধীর চৌধুরিকে ব্যক্তিগত আক্রমণ না করতেন, কৌস্তভ বাগচীও নিশ্চয় মুখ্যমন্ত্রীকে ব্যক্তিগত আক্রমণ করতেন না। কিন্তু গল্পটা ওখানেই শেষ না করে রাতে পুলিশ কৌস্তভ বাগচীর বাড়িতে চড়াও হল। অনেকটা ইডি-সিবিআইয়ের কায়দায় শনিবার সকাল সকাল কৌস্তভকে গ্রেফতার করল পুলিশ। কিন্তু বিকেল হতে না হতেই প্রমাণ হয়ে গেল রাজ্যপুলিশ ইডি-সিবিআই নয়। আর সেটা নয় কারণ তাঁদের ‘অর্ডার রক্ষা’ করতে হয়েছে। ওপরওয়ালার অর্ডার রক্ষা করতে গিয়েই মুখ পুড়েছে।
রইল গিয়ে কৌস্তভ বাগচীকে গ্রেফতার করার রাজনৈতিক লাভ লোকসান। সত্যিকথা বলতে এধরনের ঘটনা শাসক দলকে বারবার অস্বস্তিতে তো ফেলছেই, মানুষ কিন্তু ধীরে ধীরে বিরক্ত হচ্ছে। পুলিশের আরও হাজারও কাজ রয়েছে। সেই সব কাজ ছেড়ে যদি তাঁদের এমন অর্ডার রক্ষা করতে হয় যাতে মুখ পোড়ে, তাহলে পুলিশের কর্মী-আধিকারিকদের মধ্যে যেমন হতাশা তৈরি হবে তেমনই রাজ্যের মানুষের মধ্যেও বিতৃষ্ণা জন্মাবে। আদালতের সময় নষ্টের কথা নাই বা বললাম।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে লোকে একসময় জননেত্রীর তকমা দিয়েছিল। সততার প্রতীক অ্যাখা দিয়েছিল। যত দিন গড়াচ্ছে এধরনের তকমা কিন্তু তৃণমূল নেত্রীর জন্য পরিহাসে পরিণত হচ্ছে। ক্ষমতায় থাকার জন্য রাজনৈতিক লড়াইটা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ভালোমতই জানেন। কিন্তু যেভাবে তিনি বিরোধী কিংবা সমালোচকদের মুখবন্ধ করার চেষ্টা করছেন, সেটা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো ঝানু রাজনৈতিক নেতার গরিমা বাড়ায় না। বরং কৌস্তভদের যত পুলিশ দিয়ে তুলে নিয়ে যাওয়া হবে, ততই বাংলায় কৌস্তভ তৈরি হবে। একজনের সমালোচনা বন্ধ করতে বাড়িতে পুলিশ ঢুকিয়ে দিলেন, হাজার জন সমালোচনা করবে। এই টা কি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বুঝতে পারছেন না?