বাঙালির বারো মাসে তেরো পার্বণ। তবে শহুরে উৎসবের ছোঁয়ায় এখনও হারিয়ে যায়নি গ্রামের নিজস্বতা- ইতু পুজোই যার প্রমাণ। ইতু পূজা সাধারণত মহিলাদের ব্রত। কার্তিক মাসের সংক্রান্তিতে (মাসের শেষ দিন) এই ব্রত শুরু হয়। পুরো অগ্রহায়ণ মাস ধরে এই ব্রত পালন করা হয়। অগ্রহায়ণের সংক্রান্তির দিন এই ব্রত শেষ হয় ইতু বিসর্জনের মধ্য দিয়ে।
“অষ্টচাল অষ্টদূর্বা কলসপত্র ধরে। ইতুকথা একমনে শুন প্রাণ ভরে।। ইতু দেন বর, ধনে জনে বাড়ুক ঘর।।”…. এই হল ইতু পুজোর মন্ত্র। ইতু পুজো বাংলার একটি লোক উৎসব। মূলত শস্যবৃদ্ধির কামনার প্রতি অঘ্রাণ মাসের রবিবার এই পুজো করা হয়।
কিভাবে ইতু পুজো করা হয়
একটি মাটির পাত্রে মাটি ভরে কচু, কলমি লতা, আখ, শুষনি, ধান, পাঁচ কলাই প্রভৃতি (পারিবারিক প্রথা অনুসারে গাছ এবং রীতির পরিবর্তন হয়) গাছ এবং বীজ বপন করে ইতু বানিয়ে তাকে পূজা করা হয়। প্রতি দিন শুদ্ধ বস্ত্রে শুদ্ধ মনে ইতুকে জল দান করা এই পুজোর রীতি। এ ছাড়াও প্রতি রবিবার ব্রাহ্মণ দিয়ে নৈবেদ্য সহযোগে পূজা করাতে হয় এবং ইতুর ব্রত কথা শুনতে হয়। পুরো অগ্রহায়ণ মাস ধরে পূজার পর অগ্রহায়ণ সংক্রান্তিতে পুকুর বা নদীতে ইতুর বিসর্জন দিতে হয়।
ইতু পুজো আসলে কি
ইতু কী বা কে এই ব্যাপারে মতভেদ আছে। কেউ কেউ মনে করেন ইতু পূজার অর্থ হল সূর্য পূজা। এই কারণেই অগ্রহায়ণ মাসের প্রত্যেক রবিবার ব্রাহ্মণ দিয়ে ইতুর পূজা করানো হয়। ইতু শব্দটি মিতু অর্থাৎ মিত্র থেকে এসেছে। মিত্র শব্দের অর্থ সূর্য। অগ্রহায়ণ মাসে সূর্য বৃশ্চিক রাশিতে অবস্থান করে এবং এই অবস্থানে সূর্যের নাম মিত্র। এই থেকেই বাংলার ঘরে ঘরে ইতু পুজো শুরু হয়। সুতরাং ইতু পূজা মানে সূর্য পূজা।
আবার বাংলার মেয়েরা ইতুকে শস্যের দেবী হিসেবেই পূজা করে থাকে। ইতুর ঘটের গায়ে পুতুলি আঁকা এবং ভেতরে দেওয়া হয় শস্যদানা ও তৃণগুচ্ছ। খড়ের বিঁড়ের উপরেই ইতুর সরাকে বসানো হয়। এর পর ওই সরাতে দেওয়া হয় মাটি। মাটি পূর্ণ সরার মাঝে ঘট স্থাপন করতে হয়। আর বাকী অংশে থাকে কলমী, সরষে, শুষনীর মূলসহ শাক। এ ছাড়া ধানের বীজ, মানকচুর মূল লাগানো হয়। আর ছোলা মটর মুগ তিল যব সহ আট রকমের শস্যের বীজও ছড়ানো হয়ে থাকে।
কেউ কেউ আবার মনে করেন ইতু পূজা করার অর্থ হল ইন্দ্রদেবের পূজা করা। পূজা যে দেবতারই হোক না কেন, পূজার মূল উদ্দেশ্য হল সাংসারিক কল্যাণ ও শ্রীবৃদ্ধি ঘটানো। ভক্তিভরে ইতু পূজার ব্রত করলে আর্থিক উন্নতি এবং সংসারের শ্রীবৃদ্ধি লাভের সঙ্গে সঙ্গে মনোবাসনাও পূরণ হয়।
ইতু পুজোর পৌরাণিক কাহিনী
কোনও এককালে, এক দরিদ্র ব্রাহ্মণ তাঁর স্ত্রী ও দুই মেয়েকে নিয়ে অভাবের সংসারে দিনযাপন করত। ব্রাহ্মণের পেশা ছিল ভিক্ষা করা। ওই ব্রাহ্মণ পিঠে খেতে খুব ভালবাসতো। তো সেই পিঠে খেতেই ব্রাহ্মণ একদিন ভিক্ষা করে চাল, নারকেল, গুড় এনে দিল তাঁর স্ত্রীকে। ব্রাহ্মণ তাঁর স্ত্রীকে বললেন, পিঠে যাতে তার আগে কেউ না খায়।
এরপর ব্রাহ্মণ অপেক্ষা করতে লাগলেন কখন পিঠ তৈরি হবে আর তিনি খাবেন। তবে তাঁর সন্দেহ হল, পিঠে লোপাট হবে। কেউ না কেউ ঠিক তাঁর আগে খেয়ে ফেলবে। সেজন্য পিঠে ভাজার শব্দ শুনতে শুনতে ব্রাহ্মণ দড়িতে একটা করে গিঁট দিতে থাকলেন।
এরপর পিঠে ভাঁজা হলে ব্রাহ্মণের ডাক পড়ল। পিঠে খেতে দিলে ব্রাহ্মণ দড়ির গিঁট গুনে দেখেন – দুটো পিঠে কম। দরিদ্র ব্রাহ্মণ একেবারে ক্ষেপে টং হয়ে গেলন। ব্রাহ্মণের রাগ দেখে তাঁর স্ত্রী বললেন, দুই মেয়েকে দুটো পিঠে দিয়েছেন। তাই দুটো পিঠে কম পড়ছে। এই কথা শুনে বাহ্মণ তাঁর দুই মেয়ে উমনো আর ঝুমনোকে তাঁদের মাসির বাড়ি রেখে আসবেন বলে ঠিক করলেন।
পরের দিন ভোর বেলা উমনো আর ঝুমনোকে সঙ্গে করে বাহ্মণ বাড়ি থেকে বের হলেন। সারা দিন হাঁটতে হাঁটতে তাঁরা যেই না এক জঙ্গলের মধ্যে পৌঁছলেন, রাত হয়ে গেল। এবার ব্রাহ্মণের মাথায় একটা দুষ্টু বুদ্ধি এল। মেয়েরা ঘুমিয়ে পড়তেই তিনি কেটে পড়লেন। ভাবলেন, এতে সংসারের অভাব কিছুটা হলেও কমবে।
এদিকে, জঙ্গলের মধ্যে একাকী উমনো আর ঝুমনোর মাঝরাতে যখন ঘুম ভাঙল, তখন তারা ব্রাহ্মণকে না দেখতে পেয়ে ভয় পেয়ে কাঁদতে শুরু করে দিল। পাশের এক বট গাছের কাছে গিয়ে হাত জোড় করে দুজনে বললে “হে বট বৃক্ষ! মা আমাদের দশ মাস দশ দিন গর্ভে স্থান দিয়েছেন। তুমি আজ রাতের জন্য তোমার কোটরে স্থান দাও।”
দুই বোনের কষ্ট আর ব্রাহ্মণের নির্দয়তা দেখে বটবৃক্ষ দু ফাঁক হয়ে গেল। দুই বোন কোনও রকমে বট গাছের কোটরে রাত কাটিয়ে পরের দিন বিদায় নিয়ে হাঁটতে শুরু দিল। কিছুদূর যাওয়ার পরে তাদের নজরে পড়ল, মাটির সরা নিয়ে কিছু মেয়ে পুজো করছে। উমনো আর ঝুমনো পুজোর বিষয়ে তাদেরকে জিজ্ঞেস করলে মেয়েরা জানাল, এর নাম ইতুপুজো।
মেয়েরা আরও জানাল, আগের দিন উপোস করে থাকলে তবেই ইতুপুজো করা যায়। এই কথা শুনে উমনো ঝুমনো ভাবল, কাল থেকে তারাও তো কিছুই খায়নি। তাহলে তারাও ইতু পুজো করতে পারে। তাছাড়া, ইতু পুজো করলে দেবতার আশীর্বাদে তাদের সমস্যারও সমাধানও হতে পারে। এই ভেবে উমনো আর ঝুমনো ইতু পুজো করল।
দুই বোনের পুজোয় ভক্তি দেখে ইতু ভগবান অর্থাৎ সূর্যদেব দেখা দিয়ে বর প্রার্থনা করতে বললেন। উমনো আর ঝুমনো সূর্যদেবকে বলল, তাদের ব্রাহ্মণ পিতার সংসারে অভাব যেন দূর হয়, দেবতা যেন সেই বর দেন। কেননা, অভাবের তাড়নাতেই ব্রাহ্মণ দুই মেয়েক মাসির বাড়ি নিয়ে যাওয়ার নাম করে জঙ্গলে ছেড়ে পালিয়েছে। সূর্যদেব তাদের আশীর্বাদ করে অদৃশ্য হলেন।
ওদিকে আশ্চর্য্যভাবে ব্রাহ্মণের ঘর ধন সম্পদে ভরে ওঠতে লাগল। কিন্তু তাঁর স্ত্রীর মুখে হাসি উধাও। মেয়েদের কথা ভেবে চোখের জল পড়ে তাঁর। সত্যিই একদিন উমনো আর ঝুমনো বাড়ি ফিরে এল। ব্রাহ্মণের স্ত্রী মেয়েদের দেখে খুব আনন্দিত হলেন। ব্রাহ্মণও মেয়েদের কাছে সব স্বীকার করে ক্ষমা চেয়ে নিলেন। কেননা, এখন তার কোনও অভাব নেই। পিঠে আর কেউ চুরি করে খাবে না।
উমনো আর ঝুমনোর সবকথা শুনে ব্রাহ্মণ বুঝতে পারলেন মেয়েদের পুজোর ফলেই বাড়িতে সমৃদ্ধি এসেছে। সব শুনে ব্রাহ্মণের স্ত্রীও ইতুপূজা শুরু করার সিদ্ধান্ত নিলেন।
ইতু পুজোর মন্ত্র
“ইঁয়তি ইঁয়তি নারায়ণ, তুমি ইঁয়তি ব্রাহ্মণ। তোমার শিরে ঢালি জল, অন্তিম কালে দিও ফল।
মন্ত্র
অষ্ট চাল অষ্ট দূর্বা কলস্ পাত্রে থুয়ে।
শুন একমনে ইতুর কথা সবে প্রাণ ভরে ॥
ইতু দেন বর।
ধন-ধান্যে, পুত্র-পৌত্রে বাড়ুক তাদের ঘর ॥
কাঠি-কুটি কুড়াতে গেলাম
ইতুর কথা শুনে এলাম ।
এ কথা শুনলে কী হয়।
নির্ধনের ধন হয়।
অপুত্রের পুত্র হয়।
অশরণের শরণ হয়।
অন্ধের চক্ষু হয়, আইবুড়োর বিয়ে হয়, অন্তিম কালে স্বর্গে যায়।।
ইতু পুজোর শুভ দিনক্ষণ
বিশুদ্ধ সিদ্ধান্ত পঞ্জিকা অনুসারে
শ্রীশ্রী ইতু পূজার শুরু:
বাংলা– ৩০ কার্তিক, শনিবার।
ইংরেজি– ১৬ নভেম্বর, শনিবার।
শ্রীশ্রী ইতু পূজার শেষ এবং বিসর্জন:
বাংলা- ২৯ অগ্রহায়ণ, রবিবার।
ইংরেজি- ১৫ ডিসেম্বর, রবিবার।
গুপ্তপ্রেশ পঞ্জিকা অনুসারে
শ্রীশ্রী ইতু পূজার শুরু:
বাংলা– ৩০ কার্তিক, শনিবার।
ইংরেজি– ১৬ নভেম্বর, শনিবার।
শ্রীশ্রী ইতু পূজার শেষ এবং বিসর্জন:
বাংলা- ৩০ অগ্রহায়ণ, সোমবার।
ইংরেজি- ১৬ ডিসেম্বর, সোমবার।