নয়াদিল্লি – বুলডোজার মামলায় বুধবার রায় শোনাল শীর্ষ আদালত। বিচারপতি বিআর গাভাই এবং বিচারপতি কেভি বিশ্বনাথনের বেঞ্চ জানিয়ে দিল, বাসস্থানের অধিকার মানুষের মৌলিক অধিকার। এই অধিকার থেকে কোনও মানুষকে বঞ্চিত করা ‘অসাংবিধানিক’। এমনকি কেউ অপরাধ করলেও তাঁর বাড়ি ভেঙে ফেলা যায় না। এটি অসাংবিধানিক।
দীর্ঘ দিন ধরেই দেশের বিরোধী দলগুলির অভিযোগ ছিল, বিজেপি পরিচালিত একাধিক রাজ্য সরকার আইনকানুনের তোয়াক্কা না করেই বুলডোজার নিয়ে গুঁড়িয়ে দিচ্ছে বাড়িঘর। সত্যিকথা বলতে উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ ‘ভয়ঙ্কর দুষ্কৃতী, দেশবিরোধী’দের শায়েস্তা করতে এই বুলডোজারকেই মূল হাতিয়ার বানিয়েছিলেন। কিন্তু বিচারাধীন বিষয়ে কাউকে এ ভাবে ‘শাস্তি’ দেওয়ার সাংবিধানিক এক্তিয়ার বা অধিকার কোনও সরকারের আছে কি না, এই প্রশ্ন তুলতে শুরু করেন বিরোধীদের পাশাপাশি মানবাধিকার কর্মীরাও। এরপর মামলা হয় সুপ্রিম কোর্টে।
বুলডোজার নীতি নিয়ে কি বলছে সুপ্রিম কোর্ট
সুপ্রিম কোর্টের পর্যবেক্ষণ, বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রশাসন যে ভাবে ‘বিচারক’-এর ভূমিকা পালন করে কাউকে ‘দোষী সাব্যস্ত’ পর্যন্ত করে ফেলছে, তা ভারতীয় গণতন্ত্রের কাঠামোর সম্পূর্ণ বিপরীতধর্মী। আইনের ঊর্ধ্বে উঠে কাউকে শাস্তি দেওয়ার এক্তিয়ার প্রশাসনের নেই।
বুধবার বিচারপতিগাভাই বলেন, ‘‘এই ভাবে ক্ষমতার অপব্যবহার মেনে নেওয়া যায় না। কে দোষী আর কে দোষী নয়, তা কোনও ব্যক্তি বিচার করতে পারেন না। কেউ এ ভাবে আইন হাতে তুলে নিতে পারেন না।’’ আইন গণতন্ত্রের ভিত বা ভিত্তি, মনে করিয়ে দিল সুপ্রিম কোর্ট।
একই সঙ্গে আদালত জানিয়েছে, কোনও বেআইনি নির্মাণ ভাঙতে হলেও তা করতে হবে নির্দিষ্ট নিয়ম মেনেই। এ বিষয়ে সংবিধানের ১৪২ ধারা অনুযায়ী নির্দেশিকা জারি করেছে দুই বিচারপতির বেঞ্চ। শীঘ্রই সারা দেশে কার্যকরী হবে এই নিয়মবিধি। বলা হয়েছে, নির্দেশগুলির একটিরও লঙ্ঘন হলে দায়ী থাকবেন সংশ্লিষ্ট আধিকারিকেরাই। সে ক্ষেত্রে ক্ষতিগ্রস্ত সম্পত্তি পুনর্নিমাণের জন্য আধিকারিকদের নিজের বেতন থেকে ক্ষতিপূরণও দিতে হতে পারে! তবে রাস্তা ও ফুটপাতের মাঝে, কিংবা নদীর ধারে অবৈধ ভাবে তৈরি কাঠামোগুলির ক্ষেত্রে এই নির্দেশিকা প্রযোজ্য হবে না।
অবৈধ বা বেআইনি নির্মাণ নিয়ে সুপ্রিম কোর্টের নয়া নির্দেশিকা
১। কোনও বেআইনি কাঠামো ভেঙে ফেলার নির্দেশ পাশ হলেই তা সঙ্গে সঙ্গে কার্যকর করা যাবে না। অভিযুক্তকে ওই নির্দেশের বিরুদ্ধে আবেদন করার জন্য সময় দেওয়া হবে।
২। শুধুমাত্র কারও বিরুদ্ধে থাকা অভিযোগের ভিত্তিতে তাঁর বাড়ি ভাঙা যাবে না। আগে থেকে শোকজ নোটিস দিতে হবে।
৩।বাড়ি ভাঙার নির্দেশ এলে আগে ওই বাড়ির মালিককে লিখিত আকারে নোটিসটি পাঠানো হবে।
৪। নোটিসের একটি অনুলিপি বাড়ির বাইরেও সেঁটে দেওয়া হবে।
৫। সেই নোটিস পাঠানোর পর ১৫ দিন সময় দেওয়া হবে। তার পরে আরও এক সপ্তাহ অতিরিক্ত সময় পাবেন বাড়ির মালিক।
৬। ওই সময়সীমা শেষ হলে তবেই বিষয়টি জেলাশাসককে জানানো হবে।
৭। আদালতের নির্দেশ-সহ বিস্তারিত নোটিসটি একটি নির্দিষ্ট ডিজিটাল পোর্টালে আপলোড করতে হবে। কী কারণে ওই কাঠামো ভাঙা হচ্ছে, কবে আবেদনের শুনানির তারিখ নির্ধারিত হয়েছে, নোটিসে সে সবের বিস্তারিত উল্লেখ থাকতে হবে।
৮। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির আবেদন শুনে চূড়ান্ত নির্দেশ পাশ হবে। যদি ওই নির্মাণ সত্যিই বেআইনি না-হয়, তা হলে কর্তৃপক্ষকে কারণ দর্শাতে হবে।
৯। শেষ নির্দেশ আসার পর ১৫ দিন পর্যন্ত বাড়ির মালিককে অবৈধ কাঠামোটি সরানোর সুযোগ দেওয়া হবে। এর মাঝে যদি আপিল বিভাগ ওই রায়ের উপর স্থগিতাদেশ জারি না-করে, শুধুমাত্র তা হলেই বাড়িটি ভাঙতে পারবে প্রশাসন।
১০। ভাঙার গোটা প্রক্রিয়াটির ভিডিয়ো রেকর্ড করা বাধ্যতামূলক। ওই ভিডিয়ো সংরক্ষণ করে রাখতে হবে। গোটা প্রক্রিয়ার রিপোর্ট পুরসভার কমিশনারের কাছে পাঠাতে হবে।
প্রসঙ্গত, ‘বুলডোজার নীতি’ নিয়ে এর আগেও প্রশ্ন তুলেছে সুপ্রিম কোর্ট। এই মামলায় গত ১ অক্টোবর অন্তর্বতী আদেশের মেয়াদ বাড়িয়ে দিয়ে আদালত জানায়, পরবর্তী নির্দেশ না আসা পর্যন্ত কোনও বাড়ি কিংবা দোকান বুলডোজার দিয়ে গুঁড়িয়ে দেওয়া যাবে না।