তুষার খাসনবিশ
বুধবার তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়কে ইডি আরও একবার প্রায় ৯ ঘণ্টা জিজ্ঞাসাবাদ করল। এবং সেই জিজ্ঞাসাবাদের পর অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় বাইরে বেরিয়ে এসে আগের মতন করেই ফের কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থার বিরুদ্ধে চ্যালেঞ্জ ছুড়লেন। বললেন, ‘‘আমি (লিপস অ্যান্ড বাউন্ডসের) সিইও পদে রয়েছি। কিন্তু সেখানে ১০ পয়সাও ঢুকেছে কি না সেটা ইডিকে প্রমাণ করতে হবে।’’ এখানেই থেমে না থেকে অভিষেক আরও বলেন, ‘‘ক্ষমতা থাকলে গ্রেফতার করুন। প্রমাণ করুন। যদি আমি এক পয়সাও নিয়ে থাকি কথা দিচ্ছি ফাঁসির দড়ি গলায় নেব। ৩ বছর ধরে এই কথা বলে আসছি। আজও বলছি। আগামীদিনেও বলব। আমি এককথার ছেলে।’’
ইডি ডেকে কী জিজ্ঞাসাবাদ করেছে, অভিষেকই বা তার কী উত্তর দিয়েছেন, কোন মেজাজে দিয়েছেন – সেটা পরের কথা। কিন্তু জিজ্ঞাসাবাদের পর বাইরে বেরিয়ে এসে যেভাবে প্রত্যেকবার অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় নিজেকে চরম আত্মবিশ্বাসী দেখানোর চেষ্টা করেছেন, তাতে আর যাই হোক তৃণমূল নেতৃত্ব কিংবা কর্মী-সমর্থকদের মনোবল যে বাড়বে সে বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই। আর তার প্রমাণ পঞ্চায়েত ভোট থেকে শুরু করে উপনির্বাচনগুলিতে এরই মধ্যে পাওয়া গিয়েছে। এবং অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথাতেই স্পষ্ট, যতদিন ইডি তাঁকে এভাবে ডেকে ডেকে জিজ্ঞাসাবাদ করবে – ততদিনই তিনি এই কাজটা করবেন। অর্থাৎ নিজের জেদি, আত্মবিশ্বাসী মনোভাবটা তৃণমূলের নেতা-কর্মী-সমর্থকদের সামনে তুলে ধরবেন। স্বাভাবিকভাবেই এতে বিরোধীদল বিজেপি কিংবা শুভেন্দু অধিকারীরা বিপাকে পড়বেন।
বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারীও অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের এই খেলাটা ঠিক বুঝছেন। কিন্তু শুভেন্দু অধিকারীর জন্য মুশকিল হল, তিনি সববুঝেও কিছু করতে পারছেন না। অভিষেকের জন্য যা ভেবেছিলেন সেটা মোটেও হচ্ছে না। আর যতদিন গড়াচ্ছে উলটে ইডি-সিবিআইয়ের এত যে তদন্ত তা রাজ্য বিজেপির নেতাদের রাজনৈতিকভাবে ব্যাকফুটে ঠ্যালে দিচ্ছে। সেই হতাশা শুভেন্দু অধিকারী চেপে রাখেন নি। এনিয়ে মিডিয়ায় তাঁর ক্ষোভ উগরে দিয়েছেন। বলেছেন, ‘‘যা চলছে তাতে ইডির তদন্তের ওপর আমার আর ভরসা নেই।’’ যে শুভেন্দু অধিকারী কিছুদিন আগেও ইডি-সিবিআইয়ের গুণগান গেয়েছেন, সেই শুভেন্দু অধিকারীর এমন মন্তব্য নিশ্চয় বিজেপির কর্মী-সমর্থকদের মনে হতাশা তৈরি করবে। বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব নিশ্চয় এতে খুশি হবে না।
ঠিক এই জায়গাতেই প্রশ্ন উঠতে পারে, ইডি-সিবিআই যদি সত্যিই কেন্দ্রের ইশারায় কাজ করে, মোদী সরকারের অঙ্গুলীহিলনে কাউকে জেলে ঢুকিয়ে থাকে তাহলে এখন পারছে না কেন? বঙ্গ বিজেপির শীর্ষনেতৃত্বের এমন হতাশা দূর করার কোনও ব্যবস্থা হচ্ছে না কেন? বিজেপির নেতারাই যদি এই ভাবে ইডি-সিবিআইয়ের তদন্ত নিয়ে হতাশা প্রকাশ করতে শুরু করেন, তাহলে সাধারণ মানুষ কিংবা যেসব চাকুরিপ্রার্থীরা এতদিন ধরে রাস্তায় বসে আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে – তাঁরাই বা তাঁদের মানসিক লড়াইয়ের শক্তি পাবেন কোথা থেকে? ইডি-সিবিআই সত্যিই কি দুর্নীতির মাথাদের বিরুদ্ধে কোনও তথ্য খুঁজে পাচ্ছে না? না কি সিপিএমের নেতাদের যে মোদী-মমতার যোগসাজশের অভিযোগ – সেটাই তলে তলে হয়ে গিয়েছে? এমনই নানান প্রশ্ন কিন্তু সাধারণ মানুষের মনে উঠছে।
তবে এত প্রশ্নের উত্তরে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা কিন্তু অন্যকথা বলছেন। তাঁদের যেটা যুক্তি, সাধারণ মানুষের যে ভাবনা তার সঙ্গে ইডি-সিবিআইয়ের মতো পেশাদার তদন্তকারী সংস্থার কর্মপদ্ধতি কিন্তু মেলে না। আর সেই তদন্ত যদি কোনও রাজনৈতিক দলের হেভিওয়েট নেতাকে কেন্দ্রকে ঘুরপাক খেতে থাকে – তাহলে পরিস্থিতি জটিল হয়ে ওঠে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, খেয়াল রাখতে হবে যাঁদের দুর্নীতির মাথা বলা হচ্ছে তাঁদের ক্ষমতা কিন্তু শুধু দেশেই নয়, বিদেশেও ছড়িয়ে রয়েছে। অন্য রাজনৈতিক দল থেকেও সাহায্য করা হচ্ছে। শাসকদল হিসেবে যেমন এই সব হেভিওয়েটের পুলিশ-প্রশাসন সঙ্গে থাকে, তেমনই রাজ্যের অধিকাংশ মানুষের আবেগ এঁদের সঙ্গে জড়িয়ে থাকে। এই অবস্থায় একটি ভুল মানে – রাজনৈতিক ভূমিকম্প তৈরি হওয়া। এমনকী ইডি-সিবিআইয়ের একটি ভুল চাল দিল্লির চেয়ার পর্যন্ত উলটে দিতে পারে।
এই পরিস্থিতি মাটি ফুঁকে ফুঁকে পা ফেলা ছাড়া তদন্তকারী আধিকারিকদের কোনও উপায় থাকে না। এতে যা সময় লাগে তা বড় বড় খেলোয়ারের ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে দিতে পারে। আম-পাবলিক যা বাইরে থেকে কখনোই বুঝতে পারে না। কোনও একজন হেভিওয়েট নেতাকে গ্রেফতার করার আগে যে ধরণের রণকৌশল সাজানো প্রয়োজন, যে ধরণের তথ্য-প্রমাণের প্রয়োজন, যে ধরণের আইনি কুশলতা প্রয়োজন তা এক-দু’মাসে কখনোই সম্ভব নয়। তাছাড়া, রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা আরও একটি কথা বলছেন – ইডি কিংবা সিবিআই যে তথ্য-প্রমাণ যোগাড় করে সেটা অনেকটাই খড়ের গাদায় সূচ খোঁজার মতো ব্যাপার। শুধু তাই নয়, গ্রেফতারের আগে পর্যন্ত অভিযুক্ত হেভিওয়েট নিজের ক্ষমতা বলে বার বার তথ্য-প্রমাণ নষ্ট কিংবা এদিক-ওদিক করতে পারে।
একাংশ রাজনৈতিক বিশ্লেষক তো এমনটাও বলছেন, এই মুহূর্তে পশ্চিমবঙ্গে আসলে পেশাদার তদন্তকারীদের দু’পক্ষের মধ্যে মাথার লড়াই চলছে। কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থার তদন্তকে শাসকদল শুধু রাজনৈতিক প্রতিহিংসা বলেই থেমে থাকে নি, উলটে তদন্তকারী আধিকারিকদের বিরুদ্ধে পালটা পদক্ষেপও করা হচ্ছে। অর্থাৎ এক তদন্তকারী সংস্থাকে ঠেকাতে আরেক তদন্তকারী সংস্থা মাঠে নেমে লড়ছে। ফলে লড়াই কোনও কঠিন পরিস্থিতিতে হচ্ছে, নিশ্চয় বুঝতে পারছেন। ফলে সাধারণ মানুষ এই তদন্তকে যত সহজ বলে মনে করছে, ব্যাপারটা কিন্তু তত সহজ মোটেও নয়। আসলে এই মুহূর্তে পশ্চিমবঙ্গে তদন্তের নামে যা চলছে, এমনটা এর আগে ভূ-ভারতে তো বটেই, সারাবিশ্বেও কখনও ঘটেছে কি না সেনিয়ে সন্দেহ রয়েছে।
(লেখকের বক্তব্য একান্তই তাঁর নিজস্ব)