Homeসম্পাদকীয়BBC: বিবিসির জন্য বিরোধীদের মরাকান্না, পাবলিক বোকা বনবে কি

BBC: বিবিসির জন্য বিরোধীদের মরাকান্না, পাবলিক বোকা বনবে কি

- Advertisement -

অয়ন চক্রবর্তী

মঙ্গলবার ব্রিটিশ সংবাদ সংস্থা বিবিসির দফতরে আয়কর হানা দিতেই বিজেপি বিরোধী সবদল এক হয়ে মায়াকান্না কাঁদতে শুরু করছে। কংগ্রেস, তৃণমূল, সিপিএম সমাজবাদী পার্টি, শিবসেনা, সবাই এই আয়কর হানার নিন্দা করে একটাই কথা বলছে, দেশে না কি ‘অঘোষিত জরুরি অবস্থা’ চালু হয়েছে। এবং যথারীতি এর পিছনে যিনি আসল কান্ডারি তাঁর নাম নরেন্দ্র দামোদর দাস মোদী। বিরোধীদের দাবি, কেন্দ্রের নরেন্দ্র মোদী সরকার যেমন বিরোধীদের মুখ বন্ধ করতে বিভিন্ন রাজ্যে ইডি-সিবিআইকে ব্যবহার করছে, ঠিক তেমনই বিবিসির মতো সনামধন্য আন্তর্জাতিক ব্রিটিশ সংবাদ সংস্থারও মুখ বন্ধ করার চেষ্টা করছে। এনিয়ে মন্তব্য করতে গিয়ে তৃণমূল সাংসদ মহুয়া মৈত্র টুইটে কটাক্ষ করে প্রশ্ন করেছেন, ‘‘বিবিসির অফিসে যে আয়কর হানা হয়েছে, তা নিয়ে কেউ কেউ বিস্মিত। কিন্তু বিস্ময়ের সত্যিই কি কোনও কারণ আছে?’’

এ হচ্ছে গিয়ে সংবাদ মাধ্যমের স্বাধীনতা হরণের চেষ্টা। অন্যদিকে, বিজেপির নেতারাও পিছিয়ে নেই। তাঁরাও যেটা পালটা দাবি করছেন, বিবিসি আসলে ‘বিশ্বের সবচেয়ে বড় দুর্নীতিগ্রস্ত সংস্থা।’ বিজেপি মুখপাত্র গৌরব ভাটিয়ার কথায়, ‘‘ভারতে যে সমস্ত সংস্থা বা সংগঠন কাজ করছে তাদের ভারতের আইনশৃঙ্খলা মেনে চলতেই হবে। বিবিসি যদি সমস্ত আইন মানে তা হলে ভয় কিসের? বিবিসি বিশ্বের সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত সংস্থা। বিবিসির কার্যপ্রণালীর সঙ্গে কংগ্রেসের খুব মিল।’’ অর্থাৎ বিজেপি নেতারা খোলাখুলিই স্বীকার করছেন, বিবিসির দফতরে আয়কর দফতরের আধিকারিকরা হানা দিয়ে ঠিকই করেছে। কিন্তু প্রশ্ন যেটা হচ্ছে, এতদিন বিবিসির বিরুদ্ধে আয়কর আধিকারিকরা চুপ করে ছিলেন কেন? কেন তাঁদের এতদিন সক্রিয় হতে দেখা যায় নি? কিসের অপেক্ষায় এতদিন তাঁরা বিবিসিকে ছাড় দিয়ে রেখেছিলেন? আর এখনই বা কী এমন হল যে তাঁদের একেবারে ঝাঁপিয়ে পড়তে হল?

এসব প্রশ্নের উত্তর পাওয়ার আগে সবার আগে যেটা প্রশ্ন হচ্ছে, বিবিসির দিল্লি এবং মুম্বইয়ের অফিসে আয়কর হানা নিয়ে বিরোধীদের এত চেল্লামেল্লি কেন? আসলে বিরোধীদের যেটা যুক্তি, বিবিসির তথ্যচিত্রই এই আয়কর হামলার আসল কারণ। দিন পনের আগে বিবিসির একটি দু’পর্বের তথ্যচিত্রকে নিয়ে ভারতে বিতর্ক শুরু হয়। বিবিসির ওই তথ্যচিত্র গুজরাত দাঙ্গা নিয়ে তৈরি করা হয়েছে। যেখানে গুজরাত দাঙ্গার জন্য গবেষণার নামে ঘুরে ফিরে নরেন্দ্র মোদীকেই দায়ি করা হয়েছে। স্বাভাবিকভাবেই বিবিসির ওই তথ্যচিত্রকে বিশেষ উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলে দাবি করে কেন্দ্রের নরেন্দ্র মোদী সরকার। এবং ভারতে তার সম্প্রচার বন্ধ করার নির্দেশ দেয়। বিজেপি সরকারের যুক্তি হল, গুজরাত দাঙ্গা নিয়ে যখন ভারতের সর্বোচ্চ আদালত, সুপ্রিম কোর্ট নরেন্দ্র মোদীকে একাধিক মামলার পরেও ক্লিনচিট দিয়েছে তখন গবেষণার নামে বিবিসির এই তথ্যচিত্র বানানোর মানে কী? পাশাপাশি আরও যেটা প্রশ্ন, গুজরাত দাঙ্গার এতদিন পর এই তথ্যচিত্রকে সম্প্রচার করা হচ্ছে কেন? অর্থনীতিতে ভারত ব্রিটেনকে সম্প্রতি পিছনে ফেলে দিয়েছে বলে? না কি প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী এখন বিশ্ব রাজনীতিতে ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রীকেও ছাপিয়ে যাচ্ছেন বলে?

বিজেপি নেতাদের এমন প্রশ্ন তোলাই স্বাভাবিক। দেশ যখন গুজরাত দাঙ্গার মতো কালো অধ্যায়কে ভুলে এগিয়ে যেতে চাইছে, যখন দেশে হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা একেবারে বন্ধ হয়ে গিয়েছে, তখন নতুন করে গবেষণার নামে দাঙ্গার তথ্যচিত্র সম্প্রচারিত করে ব্রিটিশ মিডিয়া সংস্থা কী প্রচার করতে চাইছে? পাশাপাশি বিজেপি সমর্থকদের অনেকেই এটাও প্রশ্ন তুলেছেন, বিবিসি যদি সত্যিই এত নিরপেক্ষ হতো তাহলে ভারতকে ২০০ বছর ইংরেজদের লুট করা নিয়ে কোন গবেষণাধর্মী তথ্যচিত্র বানাচ্ছে না কেন? ভারতের কোহিনূর হিরা এখনও ব্রিটিশ রাজপ্রাসাদে চুরির মাল হিসেবে জ্বলজ্বল করছে, সেটা ভদ্রতার স্বার্থে ভারতকে ফিরিয়ে দেওয়া হচ্ছে না কেন? কেনই বা ব্রিটিশদের ষড়যন্ত্রের ফলে তিন টুকরো হয়ে যাওয়া ভারত নিয়ে বিবিসি তথ্যচিত্র বানাচ্ছে না? কেনই বা বিবিসি ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে যে চরমশত্রুতা তার পিছনে যে ব্রিটিশদেরই ষড়যন্ত্র রয়েছে, সেটা নিয়ে গবেষণা করছে না? এমনই নানা প্রশ্ন বিবিসির দিকে ছুড়ে দিচ্ছেন বিজেপির সমর্থকরা।

কিন্তু বিজেপি কিংবা মোদী বিরোধী নেতাদের তাতে কিছু যায় আসে না। তাঁদের একটাই মরাকান্না, এই মোদীর রাজত্বে ভারতের সবকিছুই চলে গেছে। মানুষের বাকস্বাধীনতা, মিডিয়ার নিরপেক্ষতা – সবই কেড়ে নেওয়া হয়েছে। মোদী দেশের প্রধানমন্ত্রী হয়ে দেশকে ডুবিয়ে দিয়েছেন। আন্তর্জাতিক মঞ্চে ভারতের লজ্জায় নাক কাটা যাচ্ছে। ভারত আর আগের ভারত নেই। এই ভারতে এখন অঘোষিত জরুরি অবস্থা চলছে। ইডি-সিবিআইকে দিয়ে মোদী সরকার সবাইকে চাবকাচ্ছে। করোনার সময় এই বিরোধীরাই লাগাতার মোদী সরকারের সমালোচনা করে বলতেন, কেন্দ্রের বিজেপি সরকার দেশের অর্থনীতিকে রসাতলে নিয়ে যাচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নরেন্দ্র মোদী দেশের অর্থনীতিকে এমন অতলে নিয়ে যাচ্ছেন যে আগামী ৩০ বছর ধরে ভারতকে খেসারত দিতে হবে। রাহুল গান্ধী, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো নেতারা এমন অভিযোগ করে শুধু থেমেই থাকেন নি, তাঁরা পথে নেমে ‘নাটকে’র মাধ্যমে আম জনতার মাথায় এই ‘ঢপের যুক্তি’ প্রায় ঢুকিয়েই ফেলেছিলেন। কিন্তু করোনা যেতেই বাস্তবে দেখা গেল বিরোধীরা, বিরোধী নেতা-নেত্রীরা, এমনকী বিরোধী সমর্থক মহান অর্থশাস্ত্রীরা যা বলেছিলেন তা শুধু মিথ্যা প্রমাণিত হয়নি, সেদিন যে সকল ইকোনমিস্টরা এসব বড়বড় কথা বলেছিলেন, তাঁদের আজ মুখ লুকিয়ে দিন কাটাতে হচ্ছে। কোনও টিভির পর্দায় আজ আর তাঁদের খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।

কিন্তু নেতাদের তো নেতাগিরি করতে হবে। তা সে লজ্জার মাথা খেয়েই হোক, কিংবা যা ঘটছে তার উলটো কথা বলেই হোক, পার্টির উনুন তো জ্বালাতে হবে! তা নাহলে পার্টি ওয়ার্কার, নেতা-সমর্থকদের পেট চলবে কী করে? সুতরাং হাতের কাছে যা পাওয়া যায় সেটাই তাঁরা খড়কুটোর মতো এখন আকড়ে ধরার চেষ্টা করছেন। এখন আর দেশের অর্থনীতি রসাতলে যাচ্ছে বলে আর মোদী সরকারকে আক্রমণ করা যাচ্ছে না। মোদী করোনা সামলাতে পারছে না – এটাও বলা যাচ্ছে না। এক আধজন ছোট কিংবা মাঝারি মাপের বিজেপি নেতা ছাড়া মোদী সরকারের বিরুদ্ধে পালটা দুর্নীতির অভিযোগও করা যাচ্ছে না। দেশের উন্নতি করতে সরকারি মোদী দেশের সব সম্পত্তি বিক্রি করে দিচ্ছে – এটাও পাবলিকে খাচ্ছে না। বাজেট কখন এল, কখন গেল – সেটাও বিরোধীরা টের পেলেন না। এই অবস্থায় আদানি আর বিবিসি ছাড়া বিরোধীদের হাতে আর রইলটা কী! সুতরাং দিন কয়েক মোদী-আদানি ঘণিষ্ঠতা নিয়ে সংসদে চিৎকার-চেঁচামেচি, হৈ-হুল্লোর চলল। যখন আদানি নিয়েও মোদী সরকারকে কাত করা গেল না তখন এই বিবিসির আয়কর হানা নিয়ে ঝাঁপাতে হল।

মোদী সরকারেরও বলিহারি! বিবিসির বিরুদ্ধে আয়কর হানা যদি করাতেই হয় তাহলে এখন কেন? বিবিসির তথ্যচিত্র নিয়ে এমনিতেই বিতর্ক চলছে। স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে, বিবিসিকে মাথায় তুলতে আর মোদীকে ‘হত্যাকারী’ প্রমাণিত করতে বামপন্থী যুবনেতারা জোর করে বিবিসির তথ্যচিত্র বিভিন্ন শহরের মানুষকে দেখানোর চেষ্টা করছে। যে ব্রিটিশ সরকারের ২০০ বছরের চাবুকেও যাঁদের পিঠের ছাল ওঠেনি, বুটের লাথিতেও মন ভরেনি – সেই ব্রিটিশ সরকারের মিডিয়া হাউসের একটি তথ্যচিত্রকেই যখন তাঁরা নিজেদের সম্পত্তি ভেবে আনন্দ পাচ্ছে – তখন সেই আনন্দে বাগড়া দেওয়া কেন? কিন্তু একথাও আবার ঠিক, আয়কর আধিকারিকরা যদি ১ বছর পরেও বিবিসির দফতরে হানা দিত – তাহলেও এই তথ্যচিত্রের প্রসঙ্গ আসত। বরং ভোটের মুখে মোদীর কারনামা বলে মানুষকে বোঝানোর চেষ্টা করত। ফলে বিজেপিও বেশ বুঝতে পেরেছে, যা করতে হয় এখনই করতে হবে। পরেরটা পরে দেখা যাবে।

আর বিজেপির কোনও নেতা যদি সত্যি সত্যিই মোদী তথ্যচিত্র দেখার পর বিবিসির বিরুদ্ধে আয়কর দফতরকে কিছু বেনিয়মের অভিযোগ করে থাকেন তাহলে তদন্তকারী আধিকারিকরাও চুপ করে হাত গুটিয়ে বসে থাকবেন কেন? সুতরাং ব্রিটিশরা যদি ভারতের প্রধানমন্ত্রীকে অপদস্ত করার জন্য তথ্যচিত্র বানাতে পারে, তাহলে বিজেপি পিছিয়ে থাকবে কেন? ভারতবাসী হিসেবে আমাদের আক্ষেপ শুধু এইটুকুই, বিরোধীরা তাঁদের রাজনীতির স্বার্থে মোদীর সমালোচনা করছেন, তার না হয় একটা যুক্তি আছে। কিন্তু আমাদের মিডিয়া হাউজগুলো বিবিসির পালটা কোনও ব্রিটেন বিরোধী তথ্যচিত্র বানিয়ে সম্প্রচার করতে পারল না কেন? ২০০ বছর ধরে যারা ভারতকে লুট করে নিজেদের দেশে পাচার করল, চুরির মাল নিজেদের বলে চালাল, বুটের লাথিতে চাবুকের আঘাতে যারা আমাদের রক্তাক্ত করল, তাদের এখনও আমরা ভদ্র বলে মনে করি কেন? সে দেশের নাগরিক হওয়ার জন্য মুখিয়ে থাকি কেন?

- Advertisement -
- Advertisement -
- Advertisement -
- Advertisement -