রাজ্য বিজেপির সভাপতি সুকান্ত মজুমদারকে খুন হওয়া ছাত্র অতনু দে ও অভিষেক নস্করের পরিবারের সঙ্গে দেখা করতে দেওয়া হল না। স্থানীয় তৃণমূল কর্মী-সমর্থকদের দাবি, বিজেপির রাজ্য সভাপতি পুরো ঘটনাটা নিয়ে রাজনীতি করতে এসছেন। তাই তারা বাধা দিচ্ছেন। কিন্তু এই ঘটনা টিভির পর্দায় দেখার পর রাজ্যের একাংশ মানুষ যেটা সোশাল মিডিয়ায় প্রশ্ন তুলছেন, সেটা হল অতনু দে’র পরিবারের মতামত নেওয়া হল না কেন? কেন পীড়িত পরিবারের কোনও সদস্য বাড়ির বাইরে এসে তৃণমূলের কর্মী-সমর্থকদের সঙ্গে গলা মিলিয়ে বললেন না – বিজেপির রাজ্য সভাপতি সুকান্ত মজুমদার, আপনাকে আমরা বাড়িতে ঢুকতে দেব না। আপনার সহানুভূতি চাই না। আপনি ফিরে যান? কেন, পাড়ার তৃণমূল কর্মী সমর্থকরা সুকান্ত মজুমদারের ফিরে যাওয়ার জন্য যুদ্ধ জয়ের উল্লাসে ফেটে পড়লেন। আনন্দে স্লোগানের তালে তালে কোমর নাচাতে শুরু করলেন? বিজেপির রাজ্য সভাপতির পীড়িত পরিবারের সঙ্গে দেখা না করতে দেওয়ার যে আনন্দ, সেই আনন্দ কী খুন হওয়া দুই ছাত্রর মায়ের বুকের হাহাকার কমিয়ে দেবে? এমনই নানা প্রশ্ন কিন্তু উঠতে শুরু করেছে। অথচ, খেয়াল করার বিষয় হল – সংবাদ মাধ্যমের ক্যামেরায় যখন খুন হওয়া ছাত্রর পরিবারের লোকেরা কথা বলছেন, তখন তাঁরা বলছেন – সিআইডি না পারলে সিবিআই তদন্ত করুক। অর্থাৎ রাজ্যপুলিশের তদন্ত প্রক্রিয়া নিয়ে তাঁদের সন্দেহ রয়েছে। প্রশ্ন রয়েছে। সেই কারণেই তো সিবিআই তদন্তের কথা তাঁরা বলেছেন। আর সেই সিবিআই তদন্তের দাবিই কী তাহলে রাজ্যের শাসকদল তৃণমূলকে আচমকা জাগিয়ে তুলল। তৃণমূলের কর্মী সমর্থকদের অতনু দের পরিবারের সামনে জড়ো হতে বাধ্য করল? বাধ্য করল, বিজেপির রাজ্য সভাপতি সুকান্ত মজুমদারকে ঘিরে ধরতে? এই আশঙ্কা অনেকের মনে আরও একটি কারণে জোড়াল হচ্ছে, কারণ আশ্চর্যের যেটা বিষয় খুন হওয়া অতনু দের পরিবারের লোকেদের সঙ্গে যখন সুকান্ত মজুমদার দেখা করতে গেলেন, যখন তৃণমূলের মহিলা বাহিনী সুকান্ত মজুমদারকে পিছু ঠেলতে লাগল, আশে-পাশে একজন মহিলা পুলিশকেও দেখা গেল না? তাহলে কি ইচ্ছে করেই মহিলা পুলিশকে সেখান থেকে সরিয়ে নেওয়া হয়েছিল? যাতে একটু এদিক-ওদিক হলেই সুকান্ত মজুমদারের বিরুদ্ধে তৃণমূলের মহিলা সমর্থক-কর্মীদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার কিংবা শ্লীলতাহানির অভিযোগ দেওয়া যেতে পারে? এমনই নানা প্রশ্ন কিন্তু মানুষের মনে উঠছে।
বিজেপির রাজ্য সভাপতিও হয়তো বিষয়টা খেয়াল করে থাকবেন, কিংবা তাঁর জন্য যে একটা ফাঁদ অপেক্ষা করছে – বুঝতে পেরেছিলেন। তাই কিছুক্ষণ ভদ্রভাবে চেষ্টা করার পরেও যখন মৃত ছাত্রর বাড়িতে ঢোকার রাস্তা পেলেন না, তখন তিনি সেখান থেকে ফিরে যাওয়াটাই ঠিক সিদ্ধান্ত বলে মনে করলেন। এবং ফিরেও গেলেন। আর যখন সুকান্ত মজুমদারের গাড়ি ফিরে যাচ্ছে ঠিক সেই সময়েই দেখা গেল তৃণমূলের সেই মহিলা কর্মী-সমর্থকরা আনন্দে নেচে নেচে সুকান্ত মজুমদার ও তাঁর সঙ্গে যাওয়া বিজেপি নেতাদের ভেঙচি কাটছেন। মুখে তাদের যুদ্ধ জয়ের হাসি। কে বলবে, যেখানে তাঁরা আনন্দে উল্লাস করছেন, ভেঙচি কাটছেন তার কয়েক ফুট দূরেই নাবালক ছেলেকে হারিয়ে বুক চাপড়ে হাহাকার করছেন খুন হওয়া ছাত্রর মা-বাবা, পরিবার পরিজন! এ কী অবস্থা বাংলার মানুষের! এ কেমন প্রতিবাদ তৃণমূলের মহিলা কর্মী-সমর্থকদের! অনেকেই প্রশ্ন তুলছেন, মাসে ৫০০টাকা করে পেলে কী একজন মহিলা এমন হয়ে যেতে পারেন? এমন আনন্দে নেচে নেচে যুদ্ধ জয়ের সেলিব্রেশন করতে পারেন? কেউ একবারও ভাবল না, বিরোধীদলের নেতার সঙ্গে খুন হওয়া ছাত্রর পরিবার দেখা করবে কিনা সেটা তাঁদের ওপরেই ছেড়ে দেওয়া হোক। কেউ একবারও বলল না, বিজেপির রাজ্যসভাপতিকে ঢুকতে না দিয়ে যুদ্ধ জয় করা গেছে বটে, কিন্তু এভাবে নেচে নেচে, হেসে হেসে আনন্দ করার কোনও মানে হয় না। কারণ এই জয় বিজেপির বিরুদ্ধে কোনও ভোটে জয় নয়, এই জয় বিজেপিকে বাংলার বাইরে রাস্তা দেখিয়ে দেওয়ার জয় নয়। আশ্চর্যের বিষয়, তৃণমূলের মহিলা-কর্মী সমর্থকদের সেটা কেউ একবারের জন্যেও বললেন না। সবাই বেমালুম ভুলে গেল, বিজেপির রাজ্যসভাপতিকে খুন হওয়া ছাত্রর বাড়িতে ঢুকতে না দিয়ে আসলে রাজনীতির খেলাটা তৃণমূলের সেই মহিলা সমর্থক-কর্মীরাই দারুণভাবে খেলে দিলেন। সবাই এটা বেমালুম ভুলে গেল, বাংলায় এবার কোনও নাবালক ছাত্র খুন হওয়া কিংবা ধর্ষণের পর মেরে ফেলা কোনও শিশু বা মহিলার পরিবার-পরিজনদের সঙ্গে দেখা করতে গেলে পার্টির পরিচয়টাই সবার আগে দেখা হবে। যিনি সমবেদনা জানাতে যাচ্ছেন, তিনি কোন পার্টি করেন – সেটা আগে বাংলার পাড়ার মাতব্বরেরা জানবেন, বুঝবেন, তারপর ঠিক হবে কাউকে খুন হওয়া ছাত্রর বাড়িতে ঢুকতে দেওয়া হবে কিনা। আর পীড়িত পরিবারের বাড়ির গেট বন্ধ করে সামনে দাঁড়িয়ে বিরোধী পার্টি বা পক্ষকে আটকানো হলেও একবারও সেই পরিবারের মত নেওয়া কিংবা বলার সুযোগ দেওয়া হবে না – যে তারা আসলে কি চান। বাংলার কপালে এটাই বাকি ছিল? এমনই প্রশ্ন কিন্তু অনেকের মনে উঠছে।
সমালোচকরা আরও বলছেন, এই ঘটনার দু‘দিন আগেই খোদ তৃণমূল নেত্রী তথা রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর সরকারের বিরুদ্ধে ওঠা চাকরি দুর্নীতির ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে বলেছিলেন, সুভাষচন্দ্র বসু বলেছন – ভুল করাটাও একটা অধিকার। সুভাষচন্দ্র বসু এই কথা বলে কী বোঝাতে চেয়েছিলেন, আর আমাদের মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী সেই কথা কোন পরিস্থিতিতে সেটা বলছেন, কেউ সে নিয়ে প্রশ্ন তুলল না। মুখ্যমন্ত্রী নিজের সরকারের দুর্নীতির অভিযোগের বেলায় বলছেন, ভুল করাটাও নাকি তাঁর অধিকার। কিন্তু এই যে দুই নাবালক স্কুল পড়ুয়াকে চলন্ত গাড়িতে গলায় রশি পেচিয়ে, ফাঁস লাগিয়ে শ্বাসরোধ করে মারা হল – তাঁদের পরিবার কার সঙ্গে দেখা করবেন না করবেন, কোন পার্টির সমবেদনা নেবেন না নেবেন – সেটা ঠিক করার অধিকারটুকুও তাঁদের নেই। এটাই কী নতুন বাংলা, এগিয়ে বাংলার উদাহরণ? অথচ, এর আগে খুন হওয়া ছাত্রর পরিবার পুলিশের কাছে গেছে, তৃণমূল নেতার কাছে গিয়েছে মন্ত্রীর কাছে গিয়েছে, মমতাদির কাছে গিয়েছে এমনকী মুখ্যমন্ত্রীর সরকারি অফিসে গিয়েছে – কই তারপরেও তো অভিষেক লস্কর কিংবা অতনু দে‘কে বাঁচানো গেল না। বাঁচানো তো দূরের কথা, ১২-১৩দিন পর এমন লাশ শেষ পর্যন্ত ওই পড়ুয়ার পরিবারকে ফিরিয়ে দেওয়া হল যাঁদের মা কিংবা বাবার নিজের ছেলের শেষযাত্রার মুখ দেখার মতো অবস্থায় ছিল না। আর এখানেই প্রশ্ন তুলছেন, পোকা ধরা হাড়গোর পচাগলা মাংসে তাল পাকানো লাশ ফিরিয়ে দেওয়াই কি আমাদের নতুন বাংলা, এগিয়ে বাংলা? পুলিশের গাফিলতি নিয়ে অনেকেই প্রশ্ন তুলছেন। পুলিশমন্ত্রী মানে স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রশাসন চালানোর ক্ষমতা নিয়েও বিরোধীরা আক্রমণ করছেন। বিজেপি কিংবা সিপিএমের নেতারা এটাও বলছেন, রাজ্যের তৃণমূল সরকার চাইছে বাংলার মানুষ বুঝুক তৃণমূল নেত্রীর ইশারা ছাড়া পুলিশ একপাও নড়ে-চড়ে না। তৃণমূলের নিজের লোক না হলে – পুলিশ তদন্তে ঝাঁপায় না। কিন্তু খুন হওয়া অতনু দে‘র পাড়ার তৃণমূল কর্মী-সমর্থকরাই বলছেন, তাঁর পরিবার নাকি তৃণমূলের সমর্থক। তৃণমূলের সমর্থক হয়েও কেন তাহলে তাঁরা সুজিত বসু, মমতাদির সঙ্গে দেখা করার পরেও তাঁদের ছেলেকে বাঁচাতে পারলেন না? তৃণমূল সমর্থকদেরই যদি এই অবস্থা হয়, তাহলে বিজেপি-সিপিএম সমর্থকদের এধরণের ঘটনায় ছেলে-কিংবা মেয়েদের তো লাশই খুঁজে পাওয়া যাবে না! এটাই কি নতুন বাংলা, এগিয়ে বাংলার নমুনা? প্রশ্ন তুলছেন, সমালোচকেরা।
আরও একটি প্রশ্ন তুলছেন সমালোচকেরা, সারাদেশের নিরিখে কেন্দ্রীয় রিপোর্টে বাংলায় সবথেকে কম খুন-খারাপি হয়েছে বলে তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক দুদিন আগেই কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহকে বাংলার তৃণমূল সরকারের কাছ থেকে শিক্ষা নেওয়ার কথা বলেছিলেন। কিন্তু একই দিনে, একই গাড়িতে দুই নাবালক ছাত্রকে দড়ির ফাঁস লাগিয়ে খুন করে দুই জায়গায় ফেলে দেওয়া হল, সেই লাশ কার, সেটা বার করতে গিয়েই বাংলার পুলিশের প্রায় ১৪দিন লেগে গেল। বাংলার এমন প্রশাসনিক ব্যবস্থা থেকে দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে কোন শিক্ষা নেওয়ার কথা বলছেন অভিষেক ব্যানার্জী? ঘটনায় মূল অভিযুক্ত সত্যেন্দ্র চৌধুরির বিরুদ্ধে পুলিশের কাছে শুরুর দিন থেকে সন্দেহ প্রকাশ করে এসেছে খুন হওয়া ছাত্রর পরিবার। পুরো ঘটনাকে কিডন্যাপের রূপ দিতে অভিযুক্তর মোবাইল থেকে তিন চার ঘণ্টা ধরে একের পর এক এসএমএস এসেছে। সেই এসএমএস দেখিয়ে ছাত্রদের পরিবার পুলিশকে বার বার বলেছে, অপরাধীদের ধরুন। কিন্তু পুলিশ দাবি করেছে, তদন্ত ৭০ শতাংশ শেষ। আপনারা নিশ্চিতে বাড়ি যান। মিডিয়ায় সামনে মুখ বন্ধ রাখবেন। ব্যস। তারপর কী ঘটল? না দুই পড়ুয়ার খুন হওয়া দেহ বেওয়ারিশ লাশ হয়ে গেল। কিন্তু পুলিশ বা মর্গ – কেউ জানল না তাদের পরিচয় কী। যে পুলিশ দাবি করছিল, ৭০ শতাংশ তদন্ত শেষ, সেই পুলিশ এখন বলছে, মূল অভিযুক্ত এখন কোথায়, তারা জানেন না। দুই ছাত্রর যখন বনগাঁ পুলিশ হাসপাতাল মর্গে পচা- গলা লাশ পরিবারের লোকেরা চিনতে পারল, যখন দুই পরিবারের লোক হাহাকারে ককিয়ে উঠল – সারা বাংলা তোলপাড় হয়ে উঠল- তারপরেও কিন্তু এনিয়ে অভিষেক ব্যানার্জী কিংবা মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মঙ্গলবার একটি মন্তব্যও করলেন না। খুন হওয়া ছাত্রর পরিবারকে সমবেদনা জানানো তো দূরের কথা। কিন্তু সেই সুযোগে যখন বিরোধীদল বিজেপির রাজ্যসভাপতি সুকান্ত মজুমদার খুন হওয়া ছাত্রর পরিবারকে সমবেদনা জানাতে এলেন, মহিলা বাহিনীকে তাঁর পিছনে লেলিয়ে দেওয়া হল। আবার সুকান্ত মজুমদারকে ফিরতে বাধ্য করে আনন্দ উল্লাস করে ভেঙচি কাটতে দেখা গেল – বাংলার মানুষ এমন কেন হয়ে যাচ্ছেন – প্রশ্ন তুলছেন সমালোচকরা।