HomeবৈঠকKuntal Ghosh: পার্থর দুর্নীতির স্কুলে কুন্তল গুডবয়

Kuntal Ghosh: পার্থর দুর্নীতির স্কুলে কুন্তল গুডবয়

- Advertisement -

অরণ্য রায়

পার্থ চট্টোপাধ্যায় যে মামলায় জেলে দিন কাটাচ্ছেন সেই নিয়োগ দুর্নীতিতেই এবার ইডি গ্রেফতার করেছে হুগলীর যুব তৃণমূল নেতা কুন্তল ঘোষকে (Kuntal Ghosh)। তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি লাখ লাখ টাকার বিনিময়ে অবৈধভাবে প্রচুর মানুষকে চাকরির ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। এই অভিযোগ প্রথমে সিবিআইয়ের কাছে করেন নিয়োগ দুর্নীতিতে আরেক অভিযুক্ত তাপস মণ্ডল। তাঁর দাবি, তিনি নিজেই কুন্তলের হাতে টাকা জমা দিয়ে রশিদ কেটে নিতেন। এবং এখন পর্যন্ত তিনি যে কুন্তলকে সাড়ে ১৯ কোটি টাকা দিয়েছেন তার পাই টু পাই হিসেব রাখা রয়েছে। এছাড়াও কুন্তল ঘোষ সরকারি চাকরি দেওয়ার নামে অন্য সোর্স থেকেও টাকা নিত। সব মিলিয়ে তাপস মণ্ডলের মিডিয়ার সামনে যা দাবি, তাতে কুন্তল ঘোষ না না করে অন্তত ৩০ কোটি টাকা তো তুলেই ছিল। কিন্তু ইডি সূত্রে যেটা খবর, কুন্তল অন্তত ১০০ কোটি টাকা চাকরি দেওয়ার নামে তুলেছিল। এই টাকা কুন্তল ঘোষ নিজের কাছে রেখেছেন, নাকি অন্য কাউকে দিয়েছেন সেটা অন্য বিতর্ক।

কিন্তু পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে কুন্তল ঘোষের (Kuntal Ghosh) শুধু মিল শুধু এটাই নয় যে দুজনকেই ইডি নিয়োগ দুর্নীতিতে গ্রেফতার করেছে। পার্থ-কুন্তলের মধ্যে আরও একটা আশ্চর্য মিল হল – দু’জনেই কুকুর ভালোবাসেন। এবং স্থানীয়রা যেটা দাবি করছেন, কুন্তলের এই কুকুরের প্রতি ভালোবাসা নাকি পার্থ চট্টোপাধ্যায়কে দেখেই। কুন্তল ঘোষের সঙ্গে পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের দারুন সম্পর্ক ছিল, সেটা আজ কারো অজানা নয়। পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে উঠবোস করতে করতেই নাকি কুকুর পোষার শখ জন্মায় কুন্তল ঘোষের। সবথেকে দামি বিদেশি হিংস্র কুকুরই কুন্তলের সব থেকে পছন্দের। আর সেজন্য ল্যাব্রাডর কিনেছিলেন তিনি।

পার্থ চট্টোপাধ্যায় নিজে যেমন এক ফ্ল্যাটে থাকতেন এবং কুকুরের জন্য অন্য ফ্ল্যাট রেখেছিলেন, কুন্তল ঘোষও অনেকটাই তাই। কুন্তল নিজে নিউটাউনে থাকলেও তাঁর ল্যাব্রাডর কুকুররা থাকত বলাগড়ের গ্রামের বাড়িতে। এই কুকুরগুলিকে দেখা-শোনা করার জন্য আলাদা করে মোটা বেতন দিয়ে কর্মচারীও রেখেছেন তৃণমূলের এই যুবনেতা। তাছাড়া, কুকুরগুলির হিংস্রতায় যাতে কোনও ধরনের খামতি না দেখা যায় সেজন্য নিয়ম করে সেগুলিকে কাঁচা মাংস খাওয়ানোর ব্যবস্থাও করেছিলেন কুন্তল ঘোষ। ল্যাব্রাডর কুকুরগুলিকে মুরগির মাংস, পাঠার মাংসের ছাঁট খাওয়ানোর জন্য বরাদ্দ করা হয়েছিল আলাদা করে বাজেট। সব মিলিয়ে এলাহি ব্যাপার। সেকালের রাজা-রাজরারা যেভাবে শখ করে হাতি পুষতেন, তেমনই পার্থ এবং কুন্তলের মতো ভিআইপিরা একালে কুকুর পোষেন।

স্থানীয় সূত্রের খবর, বাংলায় স্নাতক কুন্তল লাজুক ধরনের মানুষ। কুন্তলের বাবা, প্রয়াত স্বপন ঘোষ শ্রীপুর-বলাগড় পঞ্চায়েতের সিপিএমের প্রধান ছিলেন। কুন্তল ২০১৪ – ১৫ সাল নাগাদ নিজেই চাকরি খুঁজছিলেন। কিন্তু আচমকাই তাঁর জীবন ফুলে-ফেঁপে ওঠে যখন তিনি তৃণমূলে যোগ দিয়ে কাজ শুরু করেন। আচমকাই তিনি ধনেখালির ভান্ডারহাটিতে একটি বিএড কলেজ তৈরি করে বসেন। এবং পরে প্রভাবশালী হয়ে ওঠেন। প্রাক্তন শিক্ষামন্ত্রী, অধুনা হাজতে থাকা পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে যোগাযোগের সূত্রে শাসক দলের শীর্ষস্তরে ওঠাবসা ছিল কুন্তলের। নীলবাতির গাড়িতে তাঁকে দেখা যেত। এখন যুব তৃণমূলের রাজ্য সম্পাদক।বাড়িতে সিভিক ভলান্টিয়ারের পাহারাও দেখা গিয়েছে অনেক সময়। হুগলিতে দলের অন্তত ছয় বিধায়কের সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠতার কথা শোনা যায়।

কুন্তল তৃণমূলে যোগ দেওয়ার পর কীভাবে তাঁর আঙুল ফুলে কলাগাছ হয়েছিল, সেকথা বলাগড়ের মানুষের মুখে এখন ঘোরাঘুরি করছে। নিউ টাউন থেকে তিনি নাকি যখনই বলাগড় এলাকায় যেতেন দু-পাঁচ লাখ টাকা বিলিয়ে দিতেন। কারোও মেয়ের বিয়ে হচ্ছে না – এই নাও পাঁচ লাখ টাকা। কারোও ছেলের কঠিন অসুখ? এই নাও দু লাখ টাকা। এই করে করে কুন্তল এলাকায় একজন সমাজসেবী হিসেবে পরিচিতি পেয়ে গিয়েছিলেন। লোকেও তাঁকে সেজন্য ভালো বাসত। কুন্তলের গ্রামের বাড়ির প্রতিবেশী এক মহিলা মিডিয়াকে জানিয়েছেন, ‘‘কুন্তলকে ভাল ছেলে বলেই জানতাম। সমাজসেবা করত। ওঁর গ্রেফতারের খবরে খুব অবাক হয়েছি।’’

ওই মহিলা যেমন কুন্তলের গ্রেফতারি অবাক হয়েছেন, তেমনই বলাগড়েরই অনেক মানুষ আগেই কুন্তলের টাকা বিলোনোতে অবাক হয়েছিলেন। অনেকের মনেই প্রশ্ন উঠেছিল, কুন্তল এত টাকা পায় কোত্থেকে? তেমন কোনও কাজ করে না, আগে একটা মোবাইল সারানো ও বিক্রির দোকান ছিল, সেটাও তুলি দিয়ে শুধু পার্টি করে, অথচ এত টাকা! গাড়ি ভাড়া দিয়েই এতটাকা আসে! আশ্চর্য হওয়ারই কথা। কিন্তু সেই সময় এনিয়ে কেউ কোনও দিন মুখ খোলার সাহস পায় নি। উলটে কুন্তল বলাগড়ের বাড়িতে গেলে টাকার বিনিময়ে চাকরি প্রার্থীদের আনাগোনা বাড়ত। এলাকার পুজো-অনষ্ঠানে বড় কোনও নেতাকে আমন্ত্রণ জানানোর জন্য এলাকার নেতা-কর্মীরা কুন্তলের কাছেই ভিড় করত। আর ভিড় করত মাগনায় টাকা পাওয়া লোকেরা। সব মিলিয়ে কুন্তল ‘সমাজসেবী’ হিসেবে এলাকায় গুছিয়েই রাজত্ব করছিলেন।

এবার আসা যাক তৃণমূলে কুন্তলের উত্থান প্রসঙ্গে। বাবা সিপিএম করলেও তাঁর মৃত্যুর পর কুন্তল ছাত্ররাজনীতিতে ছাত্র পরিষদ করতে শুরু করে। তবে মমতা নয়, তিনি তৃণমূলে পরিচিত অভিষেকপন্থী হিসেবে। সুতরাং ধীরে ধীরে অভিষেক যত তৃণমূলে ক্ষমতাসীন হয়ে উঠতে শুরু করে, কুন্তলেরও তৃণমূলে ক্ষমতা বাড়তে শুরু করে। কিছুদিনের মধ্যেই এলাকায় তিনি যুব তৃণমূলের দায়িত্ব পান। এরপর ২০১৮ সালে তারকেশ্বর থেকে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জিতে জেলা পরিষদের সদস্য হয়েই কর্মাধ্যক্ষ হয়ে যান কুন্তল। তাঁর খুড়তুতো ভাইয়ের স্ত্রী সুস্মিতা বন্দ্যোপাধ্যায় শ্রীপুর-বলাগড় পঞ্চায়েতের প্রধান। তিনিও বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জেতেন। আর তারপর থেকেই আর পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি কুন্তল ঘোষকে। কিন্তু খেলা ঘুরিয়ে দিলেন শিক্ষক নিয়োগ দুর্নীতিতে নাম জড়ানো বেসরকারি বিএড ও ডিএলএড কলেজ সংগঠনের সভাপতি তাপস মণ্ডল। তাঁর দাবি, কুন্তল চাকরিপ্রার্থীদের থেকে বেশ কয়েক কোটি টাকা নিয়েছেন। গ্রেফতারের পরে যদিও কুন্তল ঘোষ দাবি করেছেন, ‘‘ আমি নির্দোষ। কারও থেকে টাকা নিইনি। তাপস মণ্ডল আমাকে ফাঁসিয়েছে।’’

জানা গিয়েছে, স্ত্রী-মেয়ে ও মাকে নিয়ে কুন্তল বছর পাঁচেক ধরে নিউ টাউনে থাকেন। আর বলাগড়ের ধাওয়াপাড়ায় কুন্তলদের দোতলা পৈতৃক বাড়ি থাকে তিনটি কুকুরের পাহারাদাড়িতে। মূল ভবন তালা দেওয়া থাকে। বাইরে খাঁচায় দশাশই তিনটি ল্যাব্রাডর আছে। কুকুর দেখাশোনার লোকও আছে। বাড়িতেই রয়েছে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত শিবমন্দির।

বলাগড় ব্লকের এক ব্যক্তি মিডিয়ার সামনে এই কুন্তল ঘোষের কান্ড সম্পর্কে স্বীকার করে বলেছেন, ‘‘কয়েক বছর আগে ছেলের চাকরির জন্য ওঁকে (কুন্তল) কয়েক লক্ষ টাকা দিয়েছিলাম। চাকরি হয়নি। কিছুটা টাকা ফেরত পেয়েছি। এখন কী হবে, চিন্তার।’’ এক চাকরিপ্রার্থীর প্রশ্ন, ‘‘উনি তো ধরা পড়লেন। টাকা কে ফেরাবে? চাকরি তো পাইনি।’’ আর একজনের দাবি, ‘‘চাকরির জন্য ওঁকে তিন লক্ষ টাকা দিয়েছি। লাভ হল না।’’

(লেখকের বক্তব্য একান্তই নিজস্ব)

- Advertisement -
- Advertisement -
- Advertisement -
- Advertisement -