কলকাতা – এই মুহূর্তে একজন মহিলা আইএএস অফিসারকে নিয়ে উথাল-পাথাল রাজ্য রাজনীতি। আর সেই আইএএস অফিসারের নাম নন্দিনী চক্রবর্তী। রাজ্যপাল সিভি আনন্দ বোসকে নিয়ে পশ্চিমবঙ্গের শাসক ও বিরোধীদের যে দড়ি টানা-টানি তার মাঝে পড়ে ফের বদলি হতে হচ্ছে তাঁকে। এই নিয়ে ৬ বার আইএএস অফিসার নন্দিনী চক্রবর্তীকে তাঁর চাকরি জীবনে বদলি হতে হল। রাজভবন সূত্রে খবর, সোমবার দিল্লিতে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের সঙ্গে বৈঠকের ঠিক আগের রাতে নন্দিনীকে দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে।
কেন নন্দিনীর বদলি
এই আইএএস অফিসারের বিরুদ্ধে শাসকদল তৃণমূলের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার অভিযোগ তুলেছেন বিরোধীদল বিজেপির নেতারা। রাজ্যপালের শপথ, সরস্বতী পুজোর দিনে ‘হাতেখড়ি’, সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজের অনুষ্ঠান থেকে বিধানসভায় বাজেট অধিবেশনে ভাষণ— এ সবের পিছনে আসলে এই নন্দিনী চক্রবর্তীরই হাত রয়েছে।
জগদীপ ধনখড় রাজ্যপাল থাকার সময়ে তাঁর প্রধান সচিব পদে ছিলেন সুনীলকুমার গুপ্ত। ধনখড় উপরাষ্ট্রপতি হলে তিনিও দিল্লি চলে যান। উপরাষ্ট্রপতির প্রধান সচিব হন। এর পরে অস্থায়ী রাজ্যপাল হিসাবে লা গণেশন দায়িত্বে এলে তাঁর প্রধান সচিব হন আইএএস নন্দিনী। এবং তারপর থেকেই রাজভবনের নানা কর্মকান্ড নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করতে দেখা গেছে বিজেপি নেতাদের। পরে আনন্দ এলেও তিনিই দায়িত্বে থাকেন। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে লা গণেশন যেভাবে তালে তাল মিলিয়ে চলতে শুরু করেছিলেন, এর পিছনে নন্দিনী চক্রবর্তীর বিশেষ ভূমিকা ছিল বলে এখন বেশ বুঝতে পারছেন বিজেপি নেতারা। লা গণেশনের মতো করেই যেভাবে রাজ্যের নতুন স্থায়ী রাজ্যপাল সিভি আনন্দ বোসও শাসক দলের ‘কথামত’ চলছেন, তাতেও এই নন্দিনীকেই দায়ী করছেন শুভেন্দু-সুকান্তরা।
কী করে নন্দিনীর কান্ড বুঝল বিজেপি
আসলে তৃণমূলের সঙ্গে নন্দিনীর ঘনিষ্ঠতা নিয়ে নতুন করে আলোচনা শুরু হয় গত দুর্গাপুজোর সময় থেকে। তৃণমূলের রাজ্য সাধারণ সম্পাদক তথা মুখপাত্র কুণাল ঘোষের পুজো হিসাবে পরিচিত রামমোহন সম্মিলনীতে নন্দিনীকে হাজির থাকতে দেখা যায়। রাজ্যপালের প্রধান সচিব ও কুণাল একসঙ্গে মঞ্চে রয়েছেন এমন ছবিও ছড়িয়ে পড়ে। সেই ছবিকে হাতিয়ার করেই বিজেপি আক্রমণ শানাতে শুরু করে। সম্প্রতি রাজ্যপালের ‘হাতেখড়ি’ অনুষ্ঠানে বিজেপির রাজ্য সভাপতি হিসাবে সুকান্ত এবং বিরোধী দলনেতা হিসাবে শুভেন্দু আমন্ত্রণ পেলেও আর কাউকে ডাকা হয়নি। অন্য দিকে, তৃণমূলের অনেক কম গুরুত্বপূর্ণ নেতারাও আমন্ত্রণ পেয়ে যান। এর পিছনেও নন্দিনীর হাত রয়েছে বলে অভিযোগ ওঠে। সেই সময়ে শুভেন্দু একটি টুইটে লিখেছিলেন যে, নন্দিনী মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের হয়ে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে রাজভবনকে ব্যবহার করছেন।
কে এই নন্দিনী চক্রবর্তী
নন্দিনী ১৯৯৪ ব্যাচের আইএএস অফিসার। অতীতে রাজ্যের বহু গুরুত্বপূর্ণ দফতের প্রশাসনিক দায়িত্ব পালন করেছেন। এখন তাঁর বিরুদ্ধে তৃণমূল ঘনিষ্ঠতার অভিযোগ উঠলেও অতীতে তাঁর সঙ্গে মমতার দূরত্ব তৈরি হওয়ার কথাও শোনা যায়। যদিও ২০১১ সালে তৃণমূল ক্ষমতায় আসার পরে নন্দিনী মমতার ‘প্রিয়পাত্রী’ হয়ে ওঠেন বলে জানা যায়। তখন শিল্পোন্নয়ন নিগমের ম্যানেজিং ডিরেক্টর ও তথ্য-সংস্কৃতি সচিবের মতো গুরুদায়িত্ব তিনি এক সঙ্গে সামলেছেন। পরে নাকি মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে মতানৈক্যের কারণে তাঁর গুরুত্ব কমতে থাকে। প্রথমে ওঁকে নিগম থেকে সরানো হয়। পরে তথ্য-সংস্কৃতিও কেড়ে নিয়ে পাঠানো হয় স্টেট গেজেটিয়ারের এডিটর পদে। সেখান থেকে সুন্দরবন উন্নয়ন। তার পর ফের প্রশাসনিক দিক থেকে প্রায় গুরুত্বহীন প্রেসিডেন্সি ডিভিশনে।
কিন্তু এখানেই গল্প শেষ হয়ে যায়নি। ২০২১ এর বিধানসভা ভোটের মুখে ফের নবান্ন নন্দিনী চক্রবর্তীর বদলির নির্দেশ জারি করে। তৃণমূল সূত্রে খবর, কেন্দ্রীয় নির্বাচন কমিশন যেভাবে ভোটের আগে রাজ্যের ডিভিশনাল কমিশনারদের বিশেষ গুরুত্ব দিচ্ছিল তাতে নন্দিনীর ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছিল। কারণ, তাঁর ডিভিশনে বিধানসভা কেন্দ্রের সংখ্যা ছিল ১৩০। সেগুলির ভোটপ্রস্তুতি নিয়ে বেশ সক্রিয় হয়ে উঠেছিলেন নন্দিনী। ভোটার তালিকা সংশোধনকালে তিনি বেশ ক’টি রিপোর্ট পাঠান নির্বাচন কমিশনে। বিধানসভা ভোটের মুখেও আইন-শৃঙ্খলা নিয়ে কমিশনে পরপর রিপোর্ট পাঠাচ্ছিলেন। তাতে শাসকদল তৃণমূলের আরও স্পষ্ট করে বলা ভাল মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ক্ষোভের মুখে পড়েন নন্দিনী চক্রবর্তী। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক নবান্নর কর্তার কথায়, ‘‘রাজ্যের পরিস্থিতি বোঝার জন্য অনেক ক্ষেত্রে কমিশনের চোখ-কান হয়ে উঠেছিলেন উনি।’’ সুতরাং বদলি।
কিন্তু কুণাল ঘোষের চেষ্টায় ধীরে ধীরে ফের মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আস্থা অর্জন করতে শুরু করেন নন্দিনী। রাজানৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, শাসক দল বেশ বুঝতে পারছিল রাজভবনে নন্দিনীকে দিয়ে অনেক আখের গোছানো সম্ভব হবে। সুতরাং তৃণমূলের তরফেই নন্দিনীর সঙ্গে সম্পর্ক ভালো করার তাগিদ অনুভব করা যায়। আর সেই সমঝোতার দায়িত্ব পরে কুণাল ঘোষের ওপরে। এবং সেই কাজে যে তিনি অত্যান্ত সফল হয়েছিলেন তার প্রমাণ দুর্গাপূজার সময়ই পাওয়া গিয়েছে। আর সেটাই এখন বিজেপি ধরে ফেলেছে। ফলে রাজভবনে আর দায়িত্বে থাকছেন না নন্দিনী।
এবার কী হবে নন্দিনীর
তবে রাজভবন থেকে বদলির পর যেটা প্রশ্ন, নন্দিনীকে সরানোর পরে কে হবেন রাজ্যপালের নতুন প্রধান সচিব? নিয়ম বলছে, রাজ্য সরকারের তরফে নতুন কোনও আইএএসকে নিয়োগ করা হবে। তবে সে ক্ষেত্রে রাজ্যপাল নিজের অপছন্দ জানাতে পারেন। আবার আগে থেকেই নিজের পছন্দের কোনও নাম তিনি নবান্নকে জানাতে পারেন। তবে সবকিছুই নাকি নির্ভর করছে সোমবার শাহ-আনন্দ বৈঠকের পরে। তবে কখন সে বৈঠক তা এখনও নিশ্চিত ভাবে জানা যায়নি।