নরেন্দ্র ভার্মা, নয়া দিল্লি
চন্দ্রযান-৩ এর মূল লক্ষ্য ছিল চাঁদের মাটি আলতো করে ছোঁয়া। ইসরোর ল্যান্ডার বিক্রম সেই কাজটা নিখুঁতভাবে তো করেছে। একইসঙ্গে রোভার প্রজ্ঞান
গত ১ লুনার দিনে (পৃথিবীর ১৪দিন) যা করেছে তাতে সারাবিশ্ব তো বটেই নাসার বিজ্ঞানীরাও চমকে গিয়েছেন। চাঁদের মাটিতে নেমে ১০০ মিটারেরও বেশি হাঁটাহাটির পাশাপাশি চারটি বিশেষ যন্ত্র দিয়ে প্রজ্ঞান চাঁদের মাটিতে অক্সেজেনের খোঁজ করার পাশাপাশি তার উত্তাপ, ভূমিকম্প হয় কি না, হলে কতটা হয় – এমনই প্রায় ড’জন খানেকেরও বেশি প্রশ্নের উত্তর খুঁজে বের করেছে। ফলে চন্দ্রযান -৩ অভিযানের সফলতা নিয়ে উচ্ছ্বসিত ভারতের বিজ্ঞানীরা।
কিন্তু এখানেই তাঁরা থেমে থাকেন নি। ল্যান্ডার বিক্রমকে ১৪দিনের জন্য ঘুম পাড়ানোর ঠিক আগের মুহূর্তে বিশেষ পরীক্ষা করেছেন। আর সেই পরীক্ষাটিরই নাম হল হপটেস্ট। আসলে বিক্রম তো আলতো করে চাঁদের মাটিতে নেমেছে। নেমে নিজের পেট থেকে প্রজ্ঞানকে বের করে দিয়ে একাধিক পরীক্ষা-নীরিক্ষাও করেছে। কিন্তু আমরা সবাই জানি, বিক্রম আর পৃথিবীতে ফিরে আসবে না। ফিরে আসবে না প্রজ্ঞানও। অর্থাৎ তারা চিরদিনের জন্য চাঁদের মাটিতেই থাকবে। সেই রকমই ইসরোর বিজ্ঞানীরা চন্দ্রযান-৩ অভিযানকে সাজিয়েছিলেন। তবে এখানেই গোপন চালটা দিয়েছে ইসরো।
বিক্রম আর প্রজ্ঞান কি চিরঘুমে গেছে?
মোটেও না। চন্দ্রযান-৩ অভিযানের ১৪ দিনের কাজের সময়সীমা হলেও তা আরও বেশকিছুদিন চলবে। অন্তত ইসরোর বিজ্ঞানীদের তেমনটাই আশা। অর্থাৎ, ল্যান্ডার বিক্রম এবং রোভার প্রজ্ঞান ১ লুনার রাতের পর (পৃথিবীর ১৪ রাত) আবার জেগে উঠবে। কেননা, তারা সূর্যের আলোতে ব্যাটারি চার্জ করে নিজের কাজকর্ম করে। যেহেতু এখন চাঁদের সাউথ পোলে রাত নেমে এসেছে সুতরাং ব্যাটারি চার্জ হবে না। তাই আপাতত ১৪ রাতের ঘুম। আর তারপ ফের সূর্য দেখা দিলেই ফের বিক্রম ও প্রজ্ঞান জেগে ওঠার জন্য নির্দেশ পাঠাবেন ইসরোর বিজ্ঞানীরা। সেজন্য ব্যাটারি ফুলচার্জ করে আপাতত স্লিপ মোডে দুজনকে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে।
আসলে চন্দ্রযান-৩ অভিযানের সফলতার পর এবার ইসরোর লক্ষ্য চাঁদের মাটিতে চন্দ্রযান-৪ পাঠানোর। সেই অভিযান ঠিক কবে হবে তা এখনও চুড়ান্ত হয়নি। তবে আশা করা হচ্ছে, ২০২৬-২৭ সালে সেটা হতে পারে। কিন্তু তার পরীক্ষা-নীরিক্ষা যে শুরু হয়ে গিয়েছে এরইমধ্যে। আর সেই পরীক্ষা-নীরিক্ষারই একটি অংশ হিসেবে বিক্রমের হপটেস্ট করেছেন ইসরোর বিজ্ঞানীরা। আর তাতে তাঁরা আশাতীত সফলতাও পেয়ে গিয়েছেন।
কী এই হপটেস্ট?
হপটেস্ট ব্যাপারটা সোজা বাংলায় দাঁড়ায় লাফানোর পরীক্ষা। চাঁদের মাটিতে দাঁড়িয়ে থাকা বিক্রমকে এদিন ইসরোর বিজ্ঞানীরা নতুন করে উড়িয়ে দেখেছেন। চাঁদের মাটি ছেড়ে প্রায় ৪০ সেমি উচ্চতায় উঠে জায়গা বদল করেছে বিক্রম। অর্থাৎ বিক্রম বুঝিয়ে দিয়েছে, এবার চাইলে ইসরোর বিজ্ঞানীরা নতুন বিক্রমকে এমনভাবে তৈরি করতে পারেন যাতে সে চাঁদের মাটি নিয়ে পৃথিবীতে ফিরে আসতে পারে। যে কাজটা সেই ষাটের দশকেই আমেরিকার মহাকাশ সংস্থা নাসা চাঁদে মানুষ পাঠিয়ে করে দেখিয়েছিল।
তারপর রাশিয়া এবং ২০১৯ সালে চিনও চাঁদের মাটি পৃথিবীতে এনেছে। তবে এই দুটি দেশ এখনও চাঁদে মানুষ পাঠাতে পারেনি। বিক্রমের মতো রোভার আর প্রজ্ঞানের মতো রোভার দিয়েই কাজ সেরেছে। চন্দ্রযান-৪ অভিযানে সেই কাজটাই করতে চাইছে ইসরো। আর সেটা করতে হলে বিক্রমের মতো রোভার চাঁদে পাঠিয়ে আবার ফিরিয়ে আনতে হবে। সেজন্য চাঁদের মাটিতে নেমে আবার সেখান থেকে উড়ে চাঁদের কক্ষপথ হয়ে পৃথিবীর কক্ষপথে পৌঁছতে হবে। এদিনের হপটেস্ট সেই কারণেই বলে মনে করা হচ্ছে। আসলে ইসরোর বিজ্ঞানীরা বিক্রমকে চাঁদের মাটিতে লাফ করিয়ে দেখে নিলেন বা বুঝে নিলেন – এরপর তাকে ফিরিয়ে আনতে হলে ইঞ্জিনে কতটা থ্রাস্ট আর কতটাই বা জ্বালানী লাগবে।
নতুন করে চাঁদের মাটি এনে কী হবে?
অনেকেই প্রশ্ন তোলেন, আমেরিকা, রাশিয়া আর চিনের মতো দেশ যখন চাঁদে গিয়ে কিছু খুঁজে পায়নি, ভারতের মতো গরীব দেশের এতটাকা খরচা করে চাঁদে যাওয়ার কি আছে? চাঁদের মাটি ভারতে এনেই বা আম পাবলিকের কী লাভ হবে? এমন প্রশ্ন যাঁরা তোলেন, তাঁদের দেশ-দুনিয়ার হাল হকিকত নিয়ে কতটা জ্ঞানগম্যি রয়েছে, সেনিয়ে প্রশ্ন উঠতেই পারে।
কেননা, প্রতিযোগিতার এই যুগে আগামীদিনে মহাকাশেই বিশ্বের বিভিন্ন দেশ তাদের ক্ষমতা দেখাতে চলেছে। কার প্রযুক্তি কতটা তুখোড় তার ওপর ভিত্তি করেই ভবিষ্যতে কোনও দেশের অর্থনীতি, বিজ্ঞান, কূটনীতি, রাজনীতির মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলি ঠিক হতে চলেছে। আমেরিকার মতো ভারতের টাকা নেই বলে যদি ইসরোর বিজ্ঞানীরা হাত গুটিয়ে বসে থাকেন তাহলে বলতেই হয়, গ্রামের ছেলের গবেষক অথবা বিজ্ঞানী নিদেন পক্ষে ডাক্তার কিংবা ইঞ্জিনিয়র হওয়ার স্বপ্ন কখনও দেখা উচিত ছিল না।
কিন্তু সেটা হয়েছে কি? আসলে জ্ঞান কিংবা বিজ্ঞানের পরিধিকে টাকা দিয়ে আটকে রাখা যায় না। গরীবের ছেলেরও হক রয়েছে বিজ্ঞানী হওয়ার। গবেষণা করার। সুতরাং টাকা নেই বলে কেউ চেষ্টা করবে না – এটা কোনও যুক্তি হতে পারে না।
তাছাড়া, টাকা থাকলে চাঁদে সবার আগে মানুষ পাঠিয়ে কিংবা চাঁদের মাটি বাড়িতে এনে বিশ্ববাসীকে তাক লাগিয়ে দেওয়া যায় বটে, কিন্তু তাতে আসল কাজটাই হয় না। খেয়াল করুন অ্যাপোলো অভিযানের মাধ্যেমে কয়েক হাজার বিলিয়ন ডলার খরচা করে আমেরিকা এতবার চাঁদে মানুষ পাঠিয়েছে, কিন্তু চাঁদে জল আদৌ আছে কিনা সেটা সুনিশ্চিত করার জন্য নাসাকে অপেক্ষা করতে হয়েছে ভারতের চন্দ্রযান-১ অভিযানের ওপরে। ‘গরীব’ ভারতের চন্দ্রযান-১ অভিযানেই আমেরিকার বিজ্ঞানীরা-সহ বিশ্ববাসী নিশ্চিত হয়েছে চাঁদে জল আছে। তবে সেটা কোনরূপে আছে, কোথায় আছে – সেটা এখনও অজানা। অথচ, আমেরিকা ৫০ বারেরও বেশি চাঁদে অভিযান করেছে, সাবেক সোভিয়েত রাশিয়াও প্রায় ৩৫ বারের বেশি চন্দ্রাভিযান করেছে। এমনকী ‘নতুন বড়লোক’ চিনও চাঁদের মাটি বাড়িতে এনে আলমারির তাকে সাজিয়ে রেখেছে। কিন্তু চাঁদে জল আছে কিনা সেটা এই ‘বড়লোক’ দেশগুলির বিজ্ঞানীরা সুনিশ্চিত করতে পারেন নি।
অথচ, ভারত টাকা বাঁচিয়ে কম খরচে প্রায় পায়ে হেঁটে চাঁদে গিয়ে এবার সালফার, অক্সিজেনের মতো গুরুত্বপূর্ণ গ্যাসের খোঁজ করে ফেলেছে। চাঁদের মাটির ওপরে কতটা উত্তাপ, নীচেই বা কতটা সেটাও জেনে ফেলেছে। আরও বহু জিনিস নিশ্চয় ইসরোর বিজ্ঞানীরা জেনেছেন। সেগুলি এখনই খোলসা করা হচ্ছে না। ঠিক সময়ে তা সবার সামনে নিয়ে এসে দুনিয়াকে তাক লাগাবে। যে কারণে যে নাসা এতদিন ভারত থেকে টাকার জোরে বিজ্ঞানীদের আমেরিকায় নিয়ে গিয়ে চাকরি দিত, সেই নাসা ইসরোর সঙ্গে একযোগে কাজ করত না। রাশিয়ার মতো দেশ প্রায় ৫০ বছর পর চাঁদের মাটিতে লুনা-২৫ নামাতে গিয়ে আছড়ে পড়ত না। চিন কিংবা ব্রিটেনের মতো দেশ হিংসায় জ্বলে-পুড়ে মরত না।
যে কথা না বললেই নয়
আসলে মহাকাশ বিজ্ঞানে ভারত বরাবরই সারাবিশ্বকে পথ দেখিয়ে এসেছে। কিন্তু একদিকে ইসলামি শাসন এবং তারপর ইংরেজদের অত্যাচারের মাঝে বিগত কয়েক শতক ভারতের কয়েক প্রজন্মের মহাকাশচর্চা তেমনটা হয়ে ওঠেনি। আর সেই ফাঁকেই টাকার জোরে আমেরিকার মতো দেশ অনেক এগিয়ে গিয়েছে। কিন্তু তাতেও ৪০ শতাংশ ভারতীয় বিজ্ঞানীর অবদান রয়েছে। এবার যদি ভারত একটু একটু করে বিজ্ঞানচর্চায় ঘুরে দাঁড়ায়, আমেরিকা, রাশিয়া কিংবা চিনের মতো দেশের সঙ্গে অল্প টাকায় টক্কর দেয়, এতে ক্ষতির কী আছে!
(প্রতিবেদক ইসরোর প্রাক্তন বিজ্ঞানী)