বাঁকুড়া – ছোট্ট একটি ঘটনা। আর তাতেই ফাঁস হয়ে গেল সবকিছু। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সভায় ভিড় জমাতে প্রশাসনকে যে খুব ভালো ভাবেই কাজে লাগানো হচ্ছে – সেটা প্রকাশ্যে চলে এল। এবং শুধু তাই নয়, ভিড়কে খুশি করতে এর আগে থেকে ‘ডিম-ভাত’ খাওয়ানোর রেওয়াজ, সেটাও বদলে ফেললেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। আজ, শুক্রবার বাঁকুড়ার বলরামপুরের সভা করবেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। এখানে মুখ্যমন্ত্রী একগুচ্ছ প্রকল্পের উদ্বোধন ও শিলান্যাস করবেন। আর বিভিন্ন প্রকল্পে ও পরিষেবা পৌঁছে দেবেন সাধারণ মানুষের দুয়ারে। তাই গোটা জেলা থেকে অন্তত ৪০ হাজার উপভোক্তাকে নিয়ে আসার কথা প্রশাসনের।
যথারীতি সেই সভার জন্য ব্যবস্থা করা হয়েছিল ‘ডিম-ভাত’-এর। কিন্তু সামনেই যেহেতু শিবরাত্রি তাই অনেক মহিলাই প্রশাসনের ‘চাপ’ সত্ত্বেও মুখ্যমন্ত্রীর সভায় আসতে রাজি হচ্ছিলেন না। কেননা, শিবরাত্রির কারণে এই সময়ে বাঁকুড়ার বেশিরভাগ মহিলাই নিরামিষ আহার করেন। কিন্তু এমন কথা কানে যেতেই টনক নড়ে মুখ্যমন্ত্রীর। এবং সভায় ভিড় যাতে কম না হয় সে কারণে রীতিমতো খাবারের মেনু বদলে ‘ডিম-ভাত’-এর বদলে লুচি-বাঁধাকপির তরকারি করে দেওয়া হয়েছে বলে খবর। পাশাপাশি রাস্তায় গাড়িতে আসতে যাতে সেই সকল মহিলাদের কোনও অসুবিধা না হয় সেজন্য গাড়িতে তাঁদের টিফিনের ব্যবস্থা করেছে ব্লক প্রশাসন।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, কেমন করে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় খবর পেলেন যে মহিলারা ‘ডিম-ভাত’ খেতে আসতে চাইছেন না? জানা গিয়েছে, এ ব্যাপারে জেলার কিছু বয়স্ক মহিলারা এই সমস্যার কথা সরাসরি বিডিওদের একথা জানান। তাঁরা বলেন যে আগামীকাল শনিবার শিবরাত্রি আছে। তাই মহিলাদের অনেকে আমিষ খাবার খাবেন না। এই কারণে সভায় আসতে আগ্রহী নন তাঁরা। এখান থেকেই খবর চলে যায় মুখ্যমন্ত্রীর কানে। নামপ্রকাশে অনিচ্ছুক জেলার এক বিডিও এমন খবরের সত্যতা স্বীকার করে জানিয়েছেন, ‘আমরা টিফিনে ডিম, কলা, কেক রেখেছিলাম। এখন ডিম, কেক বাদ দিয়ে ঝুরিভাজা, কলা, মিষ্টি দিচ্ছি। লুচি ও বাঁধাকপির তরকারি থাকবে।’
এখানে অনেকেই বলতে পারেন, মুখ্যমন্ত্রী তাঁর সভায় আসা মহিলাদের অসুবিধার কথা ভেবে যদি ‘ডিম-ভাত’-এর বদলে লুচি-বাঁধাকপির তরকারিই করে থাকেন, তাহলে এতে কী এমন মহাভারত অশুদ্ধ হয়েছে। হাজার হোক মুখ্যমন্ত্রী জনতা জনার্দনের সুবিধা-অসুবিধার কথা খেয়াল রেখেছেন, এর থেকে ভালো আর কী হতে পারে? এমন দরদী মুখ্যমন্ত্রী বাংলা কখনও দেখেছে কি? একদম ঠিক কথা। কিন্তু রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের একাংশ অন্যকথা বলছেন। তাঁর বলছেন, একটু ভিতরে তলিয়ে দেখলেই বোঝা যাবে, এর ভিতরে রাজনীতির একটা সুক্ষ্ম চাল রয়েছে। ‘খাওয়ার লোভে’ মানুষকে দিয়ে অনেক কাজই করানো যায়। প্রায় সবদলই মানুষের পেটের জ্বালাকে হাতিয়ার করে রাজনীতি করেছে বা করছে। তৃণমূলও তার বাইরে নয়। কিন্তু মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আগে এই হাতিয়ারকে অন্যদল এতটা সুক্ষ্মভাবে ব্যবহার করেছে কি না তা নিয়ে বিতর্ক হতে পারে। ইদানিং লক্ষ্য করা যাচ্ছে, তৃণমূলের যেখানেই কোনও সভা সমিতি হচ্ছে, খাওয়া-দাওয়া একটা বিশেষ ভূমিকা পালন করছে। এর আগে ক্লাবে কিংবা জেলায় এই কালচার ছিল। কিন্তু মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সেই কালচার রীতিমতো সরকারি সংস্কৃতির পর্যায়ে তুলে এনেছেন। এখন আবার মানুষের পছন্দ মতো মেনুরও ব্যবস্থা করে হচ্ছে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, এতেই প্রমানিত হচ্ছে – শাসকদল যতই বাংলার এগিয়ে থাকার ঢাক পেটাক না কেন, বাংলার আম পাবলিককে এখনও ‘খাওয়ার লোভ’ দেখিয়ে রাজনৈতিক স্বার্থসিদ্ধি করা হচ্ছে। তবে এটা নতুন কিছু নয়। বাম আমলেও এটা চলেছে। কিন্তু সেই সময় যে আড়ালটা অন্তত ছিল – তৃণমূল আমলে সেটা আর রাখা হচ্ছে না। বরং বুক ঠুকে এধরনের রণকৌশল নিয়ে মানুষকে সভা-সমিতিতে টেনে আনা হচ্ছে। পাশাপাশি বাঁকুড়ার ঘটনা প্রসঙ্গে আরও একটা কথা বলছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা, আর সেটা হল – এখন পাবলিক ডিম ভাতের ‘লোভ’কেও বুড়ো দেখাতে শুরু করেছে। অর্থাৎ ডিম ভাতের কালচারকে হয়তো আগামীদিনে চিকেন ভাতের কালচারে উন্নিত করতে হবে। তা না হলে কিন্তু তৃণমূলের জনসভায় পাবলিক কম পড়তে পারে।