তথাগত সিংহ
‘ছোটো খোকা বলে অ আ, শেখেনি কথা কওয়া’- এতদিন পর শিশুদের জন্য লেখা রবি ঠাকুরের এই দুটো লাইন যে বঙ্গরাজনীতিতে এত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে, কে তা জানত?
বুঝতেই পারছি, এই লেখাটা যখন কষ্ট করে পড়তে শুরু করেছেন, তখন ধরে নেওয়ায় যায় আপনি রাজনীতির অন্তত অ আ ক খ টুকু জানেন। তা না হলে আপনিও নির্দ্বিধায় আমাদের রাজ্যপাল মহাশয়ের মতো ‘হাতেখড়ি’ নিতে পারেন। কথায় বলে, শেখার কোনও বয়স হয় না। তা আমাদের রাজ্যপালের এই বয়সে একটু বাংলা অ আ ক খ লেখার শখ হয়েছে, এতে সমালোচনার কী আছে? কিন্তু ‘ধেড়েখোকারা’ এরই মধ্যে এনিয়ে রাজনীতির তর্জাগান শুরু করে দিয়েছেন। এবং যথারীতি সেই তর্জাগানের দুই পক্ষ হল শাসক এবং বিরোধী। আর যাঁরা এই দুই শ্রেণির কোনওটাতেই এখন পড়েন না, তাঁরা স্টেজে না উঠেই ধাইধাই নাচতে শুরু করেছেন। আর নাচের তালে তালে বলছেন, ‘‘বলেছিলাম না, মোদী-দিদি সব এক! ফের প্রমাণ হল তো!’’
এই খানে আমপাবলিক হিসেবে আমার-আপনার মনে কয়েকটা প্রশ্ন জাগতে পারে। আর সেগুলো হল – রাজ্যপালের এই বয়সে মানে এইরকম একটা সাংবিধানিক পদে থাকার পর ‘হাতেখড়ি’ নেওয়ার শখ হল কেন? তিনি তো একসময়ে এই কলকাতায় ব্যাঙ্কের কর্মী হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেছিলেন। তাহলে সেই সময় কী তাঁর বাংলা শেখার আগ্রহ তৈরি হয়নি? বা বাংলার অ আ ক খ শেখেন নি? আর সেই সময় যদি বাংলা শেখার আগ্রহ না জন্মে থাকে, তাহলে এখন কেনই বা সেটা জন্মাল?
এমন প্রশ্নের সঠিক উত্তর নিশ্চয় রাজ্যপাল মহাশয় নিশ্চয় জানেন। তবে সেটা প্রকাশ্যে মানে মিডিয়াতে কখনও বলবেন বলে মনে হয় না। সুতরাং আমাদের রাজ্যপালের ‘হাতেখড়ি’র ব্যাখ্যা পেতে রাজনীতির ফিঁসফিসানিতে কান দেওয়া আর দুয়ে দুয়ে চার করা ছাড়া কোনও উপায় নেই। এই রাজ্যপাল কেমন হবেন এনিয়ে বাংলার মানুষের যেমন একটা আগ্রহ ছিল, ঠিক তেমনই শাসক এবং বিরোধী দুয়ের মধ্যে একটা রেষারেষি ছিল। এবং সেই লড়াইয়ে এখন পর্যন্ত শাসক দলের নেত্রী যে রাজ্যপাল মহাশয়কে প্রায় পকেটে পুরে ফেলেছেন, সে বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই। বিরোধীদের অবস্থা এখন আমে-দুধে মিশে আটির মতো অবস্থা। যে কারণে রাজ্যপালের ‘হাতেখড়ি’ তাঁদের ‘চোখেরবালি’ হয়েছে। এবং কাকতালীয়ভাবে রাজ্যপালেরও ‘হাতেখড়ি’র দিনে দিল্লির দরবারে ‘ডাক’ পড়েছে।
বাংলার দায়িত্ব নেওয়ার পরই রাজ্যপাল মশাই দাবি করেছিলেন, তিনি বাংলার সব জানেন। এই সব জানার মধ্যে যে আসল বাংলাটাই নেই সেকথা জানতে বিরোধীদের একটু দেরিই হয়ে গেল। কিন্তু তার মাঝেই শাসকদলের নেত্রী রাজ্যপালকে বুঝিয়ে ফেললেন, বাংলার সব জানতে হলে আগে বাংলাটা জানতে হবে। আর সেটা শুরু করতে হবে অ আ থেকেই। রাজ্যপাল মশাই মিডিয়ায় স্বীকার করেছেন, তাঁর বাংলায় বই লেখার বহুদিনের ইচ্ছা। কিন্তু বাংলাতেই কেন বই লেখার ইচ্ছা সেটা তিনি বলেননি। হিন্দি কিংবা ইংরেজিতে বই লিখে সেটা বাংলাতে অনুবাদ করাই যায়। এতে এই অনলাইনের জমানায় অনুবাদকরা একটু খেয়ে-পড়ে বাঁচতে পারেন। কিন্তু আমাদের রাজ্যপাল সেটা না করে বরং তিনি অ আ ক খ শিখে একদিন বাংলায় বই লেখার স্বপ্ন দেখছেন। কেন দেখছেন? এর উত্তর রাজ্যপালই জানেন।
বাংলার মতো ‘অতি মিষ্টি’ ভাষায় কথা বলার ইচ্ছা অনেকের। কিন্তু তা বলে বাংলা শিখে বই লেখার ইচ্ছা প্রকাশ, তাও আবার রাজ্যপাল হিসেবে দায়িত্ব নিয়ে – এটা কেমন যেন হজম হচ্ছে না। আর এখান থেকেই গল্পের গরু গাছে চড়া। মোদী-দিদি সেটিং তত্ত্বের প্রবক্তা কমরেড প্রফেসরদের যুক্তি, দিদি দুর্নীতিচক্র থেকে বাঁচতে মোদীর কাছে ছুটে গিয়েছিলেন। তারই এখন ফসল ফলছে। মোদী-শাহ এমন রাজ্যপালকে বাংলার দায়িত্ব দিয়েছেন যিনি ধনখড়ের ধারে কাছেও যাবেন না। বরং ‘সবকা সাথ, সবকা বিশ্বাস’ নিয়ে চলার চেষ্টা করবেন। বদলে দিদি ২৪ এর লোকসভা নির্বাচনে মোদী বিরোধিতার নামে কংগ্রেসের নেতৃত্বাধীন মোদী বিরোধী জোটকে ঘেটে ঘ করে দেবেন। আর সেই কারণেই এখন রাজ্যপালকে দিয়ে অ য়ে অজগর আ -য়ে আম শেখানোর খেলা চলছে। সিবিআই – ইডি হাইকোর্টের হাতুড়ি খেয়ে তদন্তে ছুটছে বটে, কিন্তু তদন্ত মুড়োকে না ধরে ল্যাজা নিয়ে সন্তুষ্ট থাকছে। সন্দেহ নেই, এমন যুক্তি একেবারেই ফেলে দেওয়া যায় না।
এবার আসা যাক দিদির ভাইদের বক্তব্যে। তাঁরা বলছেন, এটাই তো বাংলার সংস্কৃতি! রবি ঠাকুর তো বলেই গিয়েছেন, ‘দেবে আর নেবে, মেলাবে মিলিবে’। সুতরাং রাজ্যপালকে রবি ঠাকুরের সহজপাঠ পাঠ পড়ানোর মধ্যে রাজনীতি আর দুর্নীতির দুর্গন্ধ কোথায়? দিদি নিজে কতগুলো বই লিখেছেন, তাঁর হিসেবে রাখেন না। কত ছবি এঁকেছেন, কাকে দিয়েছেন তারও খোঁজ রাখেন না। তিনি শুধু চান বাংলার মাটি বাংলার জল উন্নতি হোক, উন্নতি হোক, হে আল্লা-ভগবান-যীশু-গুরুনানক-ছট মাইয়া-বনবিবি-সালাম আলেকুম – নমস্কার- সস্শ্রেয়াকাল – অমুক- তমুক থুড়ি, মানে আমরা এক বৃন্তে দুই জোড়াফুল হিন্দু-মুসলাম, মুসলিম তার নয়ন মণি হিন্দু তাহার প্রাণ – তত্ত্বে বিশ্বাস করেন। শুধু বিশ্বাস করেন না, নজরুল এক বৃন্তে দুই ফুলের কথা বলেছিলেন, কিন্তু দিদি এক বৃন্তে কত ফুল ফোটান – শুধু দেখে যান। তারই মাঝে যদি একটু সময় বের করে কাউকে বুড়ো বয়সে খোকা সাজিয়ে বাংলা অ আ ক খ শেখার অনুষ্ঠান করার জন্য উস্কে দেওয়া যায়, এতে কোন কোরান-হাদিশ মানে ওই মহাভারত অশুদ্ধ হয়েছে। বিরোধীদের খেয়ে দেয়ে কাজ নেই তাই বিরোধিতা করছে। বিরোধীরা সরকারের সঙ্গে তালে তাল মিলিয়ে বছর ৩০ চুপ থাকবেন, তা না। শুধু পিছনে লাগা আর কোর্টে যাওয়া। ক্ষমতা থাকে তো যা এবার কোর্টে। বল গিয়ে, দিদি রাজ্যপালকে অ আ ক খ শেখানোর জন্য উস্কেছে।
না, আর যাই হোক, দিদির ভাইদের এমন চ্যালেঞ্জের বিরুদ্ধে কোর্টে যাননি বিরোধীরা। কিন্তু নালিশটা কি ঠোকেন নি রাজ্যপালের বিরুদ্ধে? তা না হলে ‘হাতেখড়ি’ নিতেই রাজ্যপালকে দিল্লি দৌঁড়তে হল কেন? বিরোধীদের কষ্ট একটাই, ধনখড় নাই বা হলেন, অন্তত রাজভবনের দরজা আর নিজের কানটা তো বন্ধ রাখবেন। বাংলার মিস্টি আর কানে মধুর বাণী শুনেই এক্কেবারে বাংলায় বই লিখবেন বলে ঠিক করে ফেললেন? ভেবে দেখলেন না, এই বয়সে বাংলা শিখলে কেমন বই লিখবেন? এপাং ঝপাং ওপাং – তো আগেই লেখা হয়ে গিয়েছে। এরপর কি আর ওসব লিখে টক্কর দিতে পারবেন? অর্থাৎ বিরোধীদের পরিষ্কার কথা, সরল শিশুর মতো মনের অধিকারী রাজ্যপাল আসলে ‘ছোটোখোকা’ হয়ে অ আ উ ঊ শিখতে গিয়ে ‘ষড়যন্ত্রে’র শিকার হয়েছেন। আর ‘দুর্নীতি’ ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টাতেই বাংলার রাজ্যপালকে ‘ছোটোখোকা’ সাজানোর ‘ষড়যন্ত্র’ করা হয়েছে।
কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, বিরোধীরা নিজেরাই নিজেদের দিল্লির নেতাদের ‘ষড়যন্ত্রে’র শিকার হচ্ছেন না তো? এই সম্ভাবনা নেই বলার চেয়ে এটা বলা ভাল, হয়তো মোদী-শাহরা বাংলায় ধনখড়ের মতো রাজ্যপাল চাননি। কিন্তু তা বলে এটাও চাননি যে রাজ্যপাল একেবারে ‘ছোটোখোকা’ সেজে অ আ শিখতে শুরু করে দিক। তাও আবার দিদির কাছে। তাই হয়তো দিল্লিতে ডাক পড়ছে। একই সঙ্গে এটাও বলা ভাল, একদিকে সিবিআই-ইডি যেমন বাংলার মাটিতে খেলতে নেমে ছক্কা নাই হাঁকাল অন্তত টুক টুক ব্যাট চালিয়ে স্কোরবোর্ড রানিং রেখেছে, তাতে ম্যাচ বের করে নিয়ে যাওয়ার একটা সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে। উলটো দিকে শাসকও বেশ বুঝেছে, এই ম্যাচে ড্র হতে পারে, হার হতে পারে, কিন্তু জয় সম্ভব নয়। তাই দর্শকদের টিভির পর্দা থেকে নজর ঘোরাতে লাগাতার অন্য খেলার আয়োজন করে চলেছে। বাংলার সেই খেলার রহস্য যদি সত্যিই রাজ্যপাল জানতেন তাহলে আর যাই হোক নিশ্চয় ‘ছোটোখোকা’ সাজতেন না।
তাহলে পাঠক, গল্পটা কী দাঁড়াল?