ঘুঘু পাখি। এই পাখির ডাক শুনলেই আমাদের মন কেমন যেন উদাস হয়ে যায়। কিন্তু ঘুঘু পাখি যদি খোদ আপনার বাড়িতেই বাসা (Ghughur basa) বানিয়ে ফেলে? তাহলে?
দেখুন, প্রযুক্তি আর ইট বালি পাথর আমাদের জীবন যতই গ্রাস করছে, পাখিরাও দিনকে দিন ভ্যানিশ হয়ে যাচ্ছে। পাখির ডাকের বদলে এখন আমাদের অটো – টোটোর হর্ণে ঘুম ভাঙার রেওয়াজ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এই পরিস্থিতিতে হঠাৎই যদি কারও বাড়িতে আচমকাই কোনও পাখি বিশেষ করে ঘুঘু কিংবা চড়ুই পাখি বাসা তৈরি করে ফেলে – তাহলে অনেকেই বেশ চিন্তিত হয়ে পড়েন।
আলোচ্য বিষয়
ভাবতে থাকেন, ‘‘ব্যাপারটা ঠিক কী হল? কেন আমার বাড়িতেই ঘুঘু এসে বাসা বাঁধল?’’ এরপরই আমাদের কুসংস্কারি মন খঁচ খঁচ করতে শুরু করে। এই রে এরপর আমার সুখি জীবনে কোনও অশান্তি ঘটবে না তো? আমার ভাগ্যে কোনও অভিশাপ নেমে আসবে না তো? সবার বাড়ি ছেড়ে আমার বাড়িতেই ঘুঘু কেন বাসা তৈরি করল?
এমনই নানা প্রশ্নে আমাদের মন নাজেহাল হতে থাকে। এবং ব্যাপারটার সঙ্গে মানিয়ে নিতে না পেরে অনেকেই আমরা ঘুঘুকে তাড়ানোর ব্যবস্থা করে ফেলি। খুচিয়ে ঘুঘুর বাসা ভেঙে দিই। কিন্তু এই কাজ কার আদৌ উচিত?
ঘুঘুর বাসা অর্থ (Ghughur basa)
আমরা শিক্ষিত মানুষ। তার ওপর আবার বাংলা ভাষায় ঘুঘুর বাসা, ঘুঘুর ফাঁদ শব্দগুলোকে নেগেটিভ অর্থে ব্যবহারের রেওয়াজ রয়েছে। এই যেমন ধরুন, আমাদের প্রত্যেকটা সরকারি অফিস এখন ঘুঘুর বাসা হয়ে দাঁড়িয়েছে। মানে, সরকারি অফিসে গোপন কর্মকান্ড চলছে।
কিংবা বাছা, ঘুঘু দেখেছ – ঘুঘুর ফাঁদ দেখ নি? মানে, এবার বুঝবে মজা কাকে বলে? অথবা, ওই লোকটা তো একেবারে ঘুঘু। মানে, ডুবে ডুবে জল খাওয়া পার্টি। এধরণের বাক্য কিংবা শব্দ ব্যবহারের কারণে স্বাভাবিক ভাবেই আমাদের মনে হতে পারে – ঘুঘু ব্যাটা মোটেও ভালো জিনিস নয়। সুতরাং ঘুঘুর বাসা ভালো হবে কী করে? অতএব, দে খুঁচিয়ে বাসা ভেঙে।
ও হ্যাঁ। বাংলায় আরও একটি কথা আছে। ভিটেয় ঘুঘু চড়িয়ে দেওয়া। মানে, ভিটে ছাড়া করে দেওয়া। আরে, কেউ যদি ভিটি ছাড়া হন, তাহলে সেখানে জঙ্গল তৈরি হবে। সেই জঙ্গলে ঘুঘু যদি বাসা বাঁধে ঘুঘুর দোষ কি? ভিটে ছাড়ানোর সঙ্গে বেচারি ঘুঘুর কি সম্পর্ক?
বাড়িতে ঘুঘুর বাসা (Ghughur basa) থাকলে কি হয়
প্রথমেই আসা যাক শাস্ত্রের কথায়। সেখানে কিন্তু আমাদের মনের উলটো কথায় বলা হয়েছে। বলা হয়েছে, যে কোনও গৃহে পাখি বাসা বাঁধলে তা অত্যন্ত শুভ ও সৌভাগ্যের প্রতীক। কারণ গৃহস্বামীর জীবনে শুরু হয় উন্নতি। ভবিষ্যৎ হয়ে ওঠে উজ্জ্বল। এখানেই শেষ নয়, মনে করা হয় বাড়িতে চড়ুই পাখি বাসা বাঁধলে তা ১০ টি নির্দিষ্ট ধরনের বাস্তুর সমস্যা নিরাময় করে।
এছাড়া খেয়াল করলেই বুঝতে পারবেন হিন্দু সনাতন ধর্মে সিংহভাগ দেবতারই বাহন হল পাখি। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, কার্তিকের বাহন ময়ূর, দেবী সবস্বতীর বাহন রাজহাঁস, বিষ্ণুর বাহন গড়ুর, শনিদেবের বাহন কাক, লক্ষ্মী মায়ের বাহন প্যাঁচা ইত্যাদি। এই কারণে, দেবী ও দেবতার পূজার সময় তাদের বাহনেরও পূজা করা হয়।
জানলে অবাক হবেন, প্রচলিত ধর্মীয় বিশ্বাস অনুসারে ঘুঘু পাখি দেবী লক্ষ্মীর ভক্ত। সুতরাং বাড়িতে ঘুঘু আসার অর্থ হল আপনার দুর্ভাগ্য এবার সৌভাগ্যে বদলে যেতে চলেছে। যে গৃহে তারা থাকে, সেই গৃহ সর্বদা আনন্দ ও সমৃদ্ধিতে পূর্ণ থাকে।
তাহলে ঘুঘুর (Ghugh Pakhi) এত বদনাম কেন
আসলে, ঘুঘু খুবই শান্তশিষ্ট পাখি। ঘুঘু সাধারণত সেখানেই বাসা তৈরি করে যেখানে শান্তি রয়েছে। নিরিবিলি জায়গাতে চুপ করে গোপনে বাসা তৈরি করে ঘুঘু ডিম পাড়ে। আপনার চোখের সামনের গাছটিতেই হয়তো ঘুঘু বাসা বেঁধেছে, কিন্তু আপনার পক্ষে সেটা খুঁজে বের করা অত সহজ নয়। কারণ ঘুঘুর বাসা খুবই ছোট আকারের হয়। এবং ঘুঘু পাখির গায়ের রং এমন যা গাছে থাকার সময় ক্যামোফ্লেজের কাজ করে। ঘুঘুর তো নিজেকে বাঁচাবার আর কোনও অস্ত্র নেই। ওই ক্যামোফ্লেজই ভরসা।
সুতরাং যখনই আমরা আমাদের জীবনে কোনও শান্তশিষ্ট-ভদ্রলোক গোছের লোকের কোনও চাঞ্চল্যকর তথ্য পাই, তখনই ঘুঘুর সঙ্গে তুলনা টেনে ফেলি। চোখের সামনেই রয়েছে, অথচ দেখতে পাইনি – ঘুঘুর বাসার ক্যামোফ্লেজও তাই। সুতরাং শান্তশিষ্ট ভদ্রলোকটির চক্করে ঘুঘু ব্যাটা বদনাম হয়ে গেল।
বিজ্ঞান কি বলে
দেখুন বিজ্ঞান এনিয়ে কী বলে এটা জানতে বিজ্ঞানী হওয়ার প্রয়োজন নেই। বিজ্ঞানের সবথেকে যদি ভালো কোনও অবদান থাকে তাহলে সেটি হল – এই পৃথিবীতে সবারই প্রয়োজন রয়েছে। বাস্তুতন্ত্র বজায় রাখতে হলে একটি ঘুঘুর যেমন পরিবেশে থাকা প্রয়োজন ঠিক তেমনই একটি শকুনের থাকার প্রয়োজন। তবেই না প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষা হবে। কিন্তু আমাদের সেসব ভাবার সময় কোথায়? সুতরাং একটি ঘুঘুর বাসা ভেঙে দিলে মহাভারত অশুদ্ধ হবে না – এই ভেবে আমরা যা করার প্রয়োজন নেই, তাই করে ফেলি।
সুতরাং, কোনওদিন যদি দেখেন ঘুঘু পাখি বাড়িতে বাসা বাঁধার চেষ্টা করছে তাহলে তাকে তাড়িয়ে দেবেন না। বাসাও ধ্বংস করবেন না। বরং ঘুঘুকে রোজ খাবার জন্য শস্যদানা ও পানের জন্য জল দিন। কারণ ঘুঘুর আসার অর্থ হল আপনার বাড়িতে কোনও অভাব আর থাকবে না। এর সোজা যুক্তি হল, আপনার বাড়িতে যদি শান্তি না থাকত, ঘুঘু বাঁধত কি? ঘুঘু নিজেও তো শান্তিতেই থাকতে পছন্দ করে। অতএব যার তার কথায় একটি নিরীহ প্রাণির সংসার ভেঙে দেবেন না। কারও সংসার ভেঙে আর যাই হোক – আপনার আমার মঙ্গল হতে পারে না।