তথাগত সিংহ
দু’দিন আগে কলকাতায় এসে বড়কথা বলে গেলেন কংগ্রেসী নেতা গুলাম নবি আজাদ। কলকাতা না কি এখন নোংরা শহরের তকমা কাটিয়ে দেশের সবথেকে পরিচ্ছন্ন যে কোনও শহরকে টেক্কা দিতে পারে। এখানেই থেমে না থেকে গুলামন নবি সাহেব আরও বলেছেন, তিনি ৪৫ বছর ধরে কলকাতায় আসছেন। আগে এই শহর ছিল দেশের সবচেয়ে নোংরা শহরগুলির অন্যতম। আর এখন সেই শহর ঝকঝক তকতক করছে। মোদ্দা কথায়, মমতা সরকারের আগে কলকাতা নামেই সিটি অফ জয় ছিল, এখন কাজে হয়েছে।
গুলাম সাহেবের এটা ব্যক্তিগত মন্তব্য। কিন্তু সেই ব্যক্তিগত মন্তব্যকেই আমাদের বঙ্গ মিডিয়া খবরের হেডলাইন বানাল। এবং বঙ্গবাসীকে খাওয়াল। কিন্তু গুলাম নবি আজাদ কেন এই সময়ে কলকাতায় এলেন, তাঁর কলকাতা সফরের গোপন উদ্দেশ্য কী, সেটা কোন খবরের কাগজে প্রকাশিত হল না। সোজা কথায়, গুলাম নবি আজাদের সঙ্গে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের এই সময়ে সাক্ষাতের মূল উদ্দেশ্য কী, সেই আসল কথাটা বাংলার কোনও মিডিয়া হাউজের লেখার মুরোদ হল না। রিপোর্টাররা হয়তো তাঁদের এডিটর সাহেবের কাছে আসল খবরটাই দিয়েছিলেন। কিন্তু সেকথা বললে বা লিখলে এডিটর সাহেবদের টিকিতে টান পড়তে পারে। খবরের কাগজের সরকারি বিজ্ঞাপনের টাকা আটকে যেতে পারে। সুতরাং খবরের হেডিং হল ‘‘নোংরা শহরে’র তকমা কাটিয়ে ‘পরিচ্ছন্ন’ কলকাতা, মুখ্যমন্ত্রী মমতার প্রশংসায় গুলাম নবি’’
হেডিংয়ের দ্বিতীয় অংশটা নিয়ে কারও কোনও আপত্তি থাকতে পারে না। কিন্তু এই যে ‘‘নোংরা শহরে’র তকমা কাটিয়ে ‘পরিচ্ছন্ন’ কলকাতা’’ এর মানে কী? কলকাতা সত্যিই যদি পরিছন্নতায় এগিয়ে থাকে তাহলে গুলান নবি সাহেবের সার্টিফিকেট প্রয়োজন হবে কেন? তিনি একজন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব। তাঁর প্রত্যেক কথার পিছনে রাজনৈতিক অভিসন্ধি লুকিয়ে থাকা কোনও আশ্চর্যের বিষয় নয়। বরং এর থেকে ভালো তো কলকাতার লোকেরাই বলতে পারবেন, তাঁরা দেশের অন্যতম পরিচ্ছন্ন শহরে থাকেন না কি আজও তাঁদের চারপাশে জঞ্জালের পাহাড় দেখতে হয়। নবি সাহেব ট্যুরিস্টও নন। কলকাতায় ঘুরতে এসে একজন দেশি কিংবা বিদেশি ট্যুরিস্টও যদি একথা বলতেন, তারও একটা মূল্য থাকত। কিন্তু গুলাম নবি সাহেব কলকাতায় এসেছিলেন বটে, কিন্তু ঘুরতে নয়। তিনি এসেছিলেন তৃণমূল নেত্রীর সঙ্গে মোলাকাত করতে। সে জন্য শীতাতপ গাড়িতে করে তাঁকে যে যে জায়গায় ঘুরতে হয়ছে সেই জায়গাগুলি তো পরিচ্ছন্ন থাকায় স্বাভাবিক। কেননা, সেই এলাকাগুলিতে আম পাবলিকরা থাকেন না। থাকেন বড়বড় নেতা-মন্ত্রী, বিশিষ্টজন বা কোটিপতি ব্যবসায়ীরা। কিন্তু কলকাতার আমপাবলিকরা যে এলাকাগুলিতে থাকেন কিংবা করে-কর্মে খান – সেই এলাকাগুলির খোঁজ গুলাম নবি সাহেব কখনও নিয়েছেন কি? গত ৪০ বছর ধরে তিনি কলকাতায় আসছেন, কখনও মেটিয়াবুরুজ, পার্কসার্কাস কিংবা বালিগঞ্জের মতো এলাকায় পায়ে হেঁটেছেন কি? আর সেটা যদি না করে থাকেন, তাহলে কী করে কলকাতাকে দেশের অন্যতম পরিচ্ছন্ন শহরের সার্টিফিকেট ধরিয়ে দিলেন? তাছাড়া, ভারত সরকারের তরফে তৈরি করা যে পরিচ্ছন্ন শহরের তালিকা, সেই তালিকার ২০টি শহরের মধ্যেও কলকাতার নাম নেই। তাহলে কিসের ভিত্তিতে নবি সাহেব কলকাতার পরিচ্ছন্নতা নিয়ে গদগদ হয়ে উঠলেন?
আসলে ব্যাপারটা খুবই সহজ। আমাদের মুখ্যমন্ত্রী বরাবরই কলকাতা তথা পশ্চিমবঙ্গের সুনাম শুনতে ভালোবাসেন। প্রশংসা শুনতে ভালোবাসেন। প্রশংসা কার না ভালো লাগে। পশ্চিমবঙ্গবাসী হিসেবে কেউ যদি কলকাতার প্রশংসা করেন সেটা আমার-আপনারও ভালো লাগার কথা। কিন্তু আপনি যেটা নন, সেটা বলে কেউ আপনার প্রশংসা করে – তাহলে বুঝতে হবে ‘দাল মে কুছ কালা হ্যায়।’ গুলাম নবি আজাদের এই প্রশংসাতেও সেইরকমই একটা আভাস পাওয়া যাচ্ছে। মমতা ব্যানার্জী কিংবা গুলাম নবি আজাদরা রাজনৈতিকভাবে সহকর্মী। কংগ্রেস পার্টি করার সুবাদে মমতার সঙ্গে গুলামের পরিচয়ও বহুদিনের। মমতা কংগ্রেস ছেড়ে তৃণমূল বানানোর পরেও সেই সম্পর্ক বজায় রেখেছিলেন গুলাম নবি। কিছুদিন আগেও কংগ্রেসের সঙ্গে মমতার বনিবনার ব্যাপারে এই গুলাম নবিকে সনিয়া গান্ধীর দূতের ভূমিকায় কলকাতায় আসতে দেখা গেছে। সেই গুলাম নবিই এখন কংগ্রেস ছেড়ে নতুন দল ডেমোক্রেকিট আজাদ পার্টি বানিয়েছেন। কিন্তু সেই দল খুব একটা হালে পানি পাচ্ছে না। কংগ্রেস থেকে বেরিয়ে এসে বহু নেতা নিজের দল বানিয়েছিলেন। কিন্তু মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কিংবা শরদ পাওয়ারের মতো জনা কয়েক নেতা ছাড়া কেউ-ই তেমন সফল হননি। সেই রিস্কটাই এখন নিয়েছেন গুলাম নবি আজাদ। প্রথমে ভেবেছিলেন বিজেপিতে একটা ঠাঁই খুঁজে নেবেন। কিন্তু সারা জীবন যে রাজনৈতিক মতাদর্শ নিয়ে গান্ধী পরিবারের হয়ে রাজনীতি করছেন, তার ঠিক উলটো পিঠে গিয়ে মুসলমান হয়ে গেরুয়া শিবিরে যোগ দেবেন – সেই ঝুঁকি হয়তো গুলাম নবি সাহেবের জন্য বড্ড বেশি বলে মনে হয়েছে।
এই পরিস্থিতিতে রাজনৈতিক জীবনের শেষ পর্বে এসে তিনি নিজের দল গড়ার স্বপ্ন দেখছেন। সেই দল আগামীদিনে আদৌ টিকে থাকবে কি না সে নিয়ে অনেকের মনেই প্রশ্ন রয়েছে। এই অবস্থায় তৃণমূলের মতো আঞ্চলিক দলের লেজুড় হয়ে যদি কোনও মতে ভারতের রাজনৈতিক সমুদ্রে ভেসে থাকা যায় – সেই চেষ্টায় করছেন গুলাম নবি আজাদ। এর মধ্যে ভুলের কিছু নেই। তিনি নিজের দল বাঁচাতে কার লেজুড় হয়ে থাকবেন, কোন দলের সঙ্গে জোট করবেন – সেটা একান্তই গুলাম নবি সাহেবের ব্যক্তিগত ব্যাপার। কিন্তু নিজের ব্যক্তিগত স্বার্থের জন্য বাংলা কিংবা কলকাতার ফাঁপা তারিফ করা বন্ধ করলে অন্তত বাংলার মানুষের ভালো হয়। তারিফ যদি করতেই হয় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের করুন। কলকাতা যা নয়, বাংলার মানুষ যা পায় নি – তা নিয়ে অযথা ভুল বোঝানোর চেষ্টা করবেন না। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বাংলার বদনাম না কি সহ্য করতে পারেন না। বাংলার মানুষের অপমান সহ্য করতে পারেন না। কিন্তু তা বলে বাংলা যা নয়, সেটা নিয়ে গলা ফাটালেই তো আর বাংলা সেটা হয়ে যাবে না। বরং কেউ যদি খালি পেটে থাকে, তাঁকে যদি বলা হয় – আজকাল তো দারুন খাওয়া দাওয়া করছেন, এমন কথা ওই ব্যক্তিকে গালাগালি দেওয়ার মতোই শোনাবে। লোক লজ্জায় হয়ত সেই বাড়ির কর্তা বা কর্ত্রী বাইরে বলে বেড়াবেন, ‘‘না না, আমাদের কোনও অসুবিধা নেই। আমরা খুব ভালোই রয়েছি।’’ তার মানে এই নয় যে – সেটাই সত্যি। আর সেই বাড়ির কর্ত্রীকে খুশি করতে গুলাম নবি সাহেব তাঁকে যা প্রশংসা করার করুন। কিন্তু বাড়ির যে সদস্যরা লাগাতার এই মিথ্যা সহ্য করছে তাঁদের মিথ্যা প্রশংসা করে কাটা ঘায়ে নুনের ছিঁটে দেবেন না – প্লিজ।