তথাগত সিংহ
আমার পাশের বাড়ির পল্টু একটু অন্য ধরণের। অন্য ধরণের মানে – ওর বাঁকা পথ পছন্দ। এই ধরুন, সবাই দুপুরবেলা ভাত খায়, ওর চায় সরবত। আর ভাতটা চায় সাত সকালেই। এরকম আরও অনেক উদাহরণই আছে। তো এহেন পল্টুর বিয়ে দেওয়ার জন্য বহুদিন ধরেই ওর বাবা-মা আমার কাছে হত্যে দিয়ে পড়ে থেকেছেন। আমি চিরকুমার মানুষ। ওঁরা মনে করেন, আমাকে দেখেই নাকি পল্টুর বিয়ের প্রতি অনিহা জন্মেছে।
শেষে আমাকেই পল্টুর কাছে বিয়ের কথা পাড়তে হল। বললুম, বিয়ে না করলে কিন্তু আমার দশা হবে। সুতরাং দেরি না করে সময় থাকতে বিয়ে করে ফেল।
একথা শুনে পল্টু উলটে আমায় যা বলল, তাতে আমার চাল আমাকেই মাত করে দিল। পল্টু বলে কিনা – কাকা আমি তো তোমার মতই জীবন কাটাতে চাই। হাত-পা ছাড়া নির্ঝঞ্ঝাট জীবন। কখন খেলাম, কী খেলাম, স্নান করলাম কি করলাম না, দাঁত মাজলাম কি মাজলাম না – কেউ ভেজর ভেজর করবে না।
আমি তো এমন উত্তর শুনে আকাশ থেকে পড়লুম। আমি নিজেই বিয়ে জিনিসটা পছন্দ করিনা। অবশ্য প্রেমে ঘা খাওয়ার ব্যাপারটাও রয়েছে। কিন্তু আমার এই পড়তি বয়সে কেন জানিনা মাঝে মাঝে মনে হয় – বিয়েটা করলে মন্দ ছিল না। বিয়ে না করেই বা সুখ কোথায়। দাঁত না মেজে, কাপড় না কেচে হয়তো বেশ কয়েকদিন চালানো যায়। কিন্তু ঘুরে ফিরে দাঁতে পোকা ধরে ব্যথা হলে, আর ঘরে কাপড়ের পাহাড় জমলে সেই তো নিজেকেই মূল্য চোকাতে হয়।
না না, এই পল্টু ছোড়া বড় ভুল করছে। আমি বেশি ঘুরিয়ে ফিরিয়ে কথা বলতে পারিনা। সেই জন্যই কিনা জানিনা, আমার পাড়া-পড়শিরা আমাকে ঠোঁটকাটা, পেটফুটো নানা নামে আড়ালে ডাকে। পল্টুও ডাকে কিনা জানি না। ডাকলেই বা কী! আমি কারো ধার ধারি না। তাই পল্টুকে একেবারে সোজাসাপ্টা প্রশ্নটাই করলাম – বলি কারও সঙ্গে প্রেম-ট্রেম করো নাকি হে? যদি করো আমাকে নির্দ্বিধায় বলতে পার। আমি সেখানেই তোমার বাবা-মা‘কে বলে বিয়ের ব্যবস্থা করাব – কথা দিচ্ছি।
পল্টু হো হো করে হেসে বলল – কাকা তুমি পাগল? ওসব প্রেম-ফ্রেম তোমার সময়ে ছিল। আমাদের ওত ধৈর্য, সময় কোনটাই নেই। গার্লফ্রেন্ড পর্যন্তই সব। তবে হ্যাঁ, পুরনো দিনের গানে শুনেছি – পালকিতে করে নাকি বউ বরের ঘরে যেত। সেসব দিন থাকলে না হয় একটা বিয়ে করে দেখাই যেত – কেমন লাগে।
আমি বললাম – দিল্লি কা লাড্ডুর গল্প শোননি। কেমন লাগে-ফাগে ওসব বাদ দাও। বাবা-মা‘র প্রতি তো কর্তব্য আছে। আমরা চারভাই। আমি ছাড়া সবাই বিয়ে করেছে। বাবা-মায়ের বউ-বউমা-নাতি-নাতনির সব শখ মিটেছে। আমার বিয়ে করা না করাতে কারও কিছু যায় আসেনি। কিন্তু তুমি তো তোমার বাবা-মা‘র ওয়ান এন্ড অনলি সন্তান। তোমাকে তো কিছু দায় মেটাতেই হবে।
পল্টুর এসব দায়-দায়িত্বর কথা মাথায় ঢুকল কিনা জানিনা – ফস করে বলে উঠল – কাকা তুমি পারবে পালকিতে করে আমার বউ আনতে? যদি পার – আমি বিয়ে করব।
মহা মুশকিল হল। এ তো দেখছি ছোড়ার বিয়ের ব্যবস্থা করতে আমাকে সিনেমার সাজানো বিয়ের ব্যবস্থা করতে হবে! মাথাটা গরম হয়ে গেল। নিজে বিয়ে করিনি। কিন্তু আরেকজন বিয়ে করবে বলে – তারজন্য আমাকে এখন পালকির ব্যবস্থা করতে হবে। তারপরই উনি বিয়ে করবেন। আসলে পল্টু আমাকে তার কাকার বদলে মামা ভেবে বসে আছে। তা নাহলে কেউ বিয়ে করার জন্য এমন মামা বাড়ির আব্দার করে?
আমি ক্ষেপে গিয়ে বললুম, তাই সই। তোমার বিয়ে পালকিতেই করাব। রাজি?
পল্টু একটুও না ভেবে বলল – মায়ের নাকি কান্নার সিরিয়ালের পালকি হলে কিন্তু চলবে না। একদম ওরিজিনাল পালকি, ওরিজিনাল পরিবেশ, ওরিজিনাল বেহারা হতে হবে। তাহলে আমি রাজি। তবে মনে রেখ, হারলে কিন্তু তোমাকেও বিয়ের পিড়িতে বসতে হবে।
আচ্ছা বেহায়া ছোকরা। কাকার বয়সিকে বিয়ের কথা বলতে একটুও মুখে বাঁধল না। এখনকার ছেলে-ছোকরাগুলোর হয়েছে এই অবস্থা। না আছে শিক্ষা না আছে সংস্কৃতি। ওই সারাক্ষণ মোবাইল, কম্পিউটার, ল্যাপটপ করে টপরটপর কথা বলতে শিখেছে। আমাকে উনি ভয় দেখাচ্ছেন বিয়ের কথা বলে। আমিও বলে দিলাম – তাই হবে। তবে আমি যেখানে বিয়ে দেব, তোমাকে সেখানেই বিয়ে করতে হবে।
সেদিন ওই পর্যন্তই। কিন্তু তারপর আমাকে পল্টু ছোড়ার বিয়ের জন্য যে গ্রামে-গঞ্জে এত ছোটাছুটি করতে হবে – জানতুম না। আগে জানলে পল্টুর এই জিদের নৌকায় আমি চড়তুম না। আহা- গলাখানা ছিল রুনা লইলার। দেশ ভাগ না হলে একবার রুনা লইলাকে প্রেম নিবেদন করে দেখতুম। রুনা লইলার প্রেম প্রত্যাখানের পর আমার এই চির কৌমার্য স্বার্থকতা পেত। কিন্তু যাকে প্রেম করে জীবনে ঠকলুম, তিনি এখন দিব্যি নতুন-বউ সংসার নিয়ে বড়লোকের ঘর-সংসার করছেন। আর আমি হয়েছি ছাই ফেলতে ভাঙা কুলো!
শেষ পর্যন্ত অনেক খুঁজে-টুজে উত্তরবঙ্গের দিনাজপুরের কাছাকাছি একটা এলাকায় পালকিতে চড়ে বিয়ের রেওয়াজের কথা শুনে সেখানে গিয়ে পাত্রী দেখে এলুম। পাত্রী দেখতে মন্দ নয়। পল্টুর বাবা-মারও বেশ পছন্দই হয়েছে বলতে হবে। পল্টুকে মেয়ে দেখানোর প্রয়োজন নেই। সে আমার কাছে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। তবু ছবি দিয়েছি। কিন্তু একটা মুশকিল আছে। সামান্যই বলতে হবে। সেটা পার করতে পারলেই এই ফাল্গুনেই চারহাত এক হয়ে যাবে।
পল্টুর বাবা-মায়ের কাছে মেয়ে দেখার কথা পাড়লুম। ওঁরা তো আমার ওপর এতটাই খুশি যে কনে কেমন তাতে কিছু যায় আসে না। কিন্তু জানি, পরে আমাকে এই বাড়ি পরিত্যাগ করতে হবে। বউ-শ্বাশুড়ির গল্প তো সবারই জানা। তাও একবার মেয়ে দেখার কথা বললুম। ওঁরা শুধু জানতে চাইল, মেয়ে কেমন? বললাম, নুনে গুণে সরস্বতী। পল্টুর বাবা বলল, ইয়ার্কিটা ভালোই কর দেখছি। বললাম, দাদা সত্যি কথায় বলছি। একটু মানিয়ে নিতে পারলেই মেয়ে আপনার ঘরের লক্ষ্মী হয়ে উঠবে। পল্টুর মা বলল – আমি বেঁচে আছি কী করতে! সব সামলে নেব।
পল্টু দেখি কিন্তু পরন্তু না করেই রাজি হয়ে গেল। শুধু বলল – কাকা, মেয়ে দেখতে যাব আমরা ঠিক সরস্বতী পুজোর দিন। আগে তোমরা এই সরস্বতী পুজোর দিনেই নাকি ভ্যালেন্টাইন ডে পালন করতে। তাই আমার প্রেম কিংবা বিয়ে যাই হোক কেন – সেটার শুভমুহূর্তের শুরু এই সরস্বতী পুজোর দিনেই হবে।
আমি বললাম, তাই হবে বৎস্য। এ আর এমন কী! মেয়ের বাবারও আপত্তি থাকার কথা নয়। কিন্তু পরে সেকথা জানাতে গিয়ে দেখলাম পাত্রীর বাড়িতে আপত্তি রয়েছে। আমি বুঝতে পারলাম না কেন। কিন্তু এই আছিলায় পল্টু যাতে বিয়ের পাট না চুকিয়ে দেয় সেজন্য মেয়ের বাবা-মা‘র ওপর একটু জোড়াজুরিই শুরু করে দিলাম। পল্টুর সব বায়নার কথা তো আর সবাইকে বলা যায় না। মেয়ের বাবা-মাকে তো নয়ই। সুতরাং যা তর্ক করার আমাকে দিয়েই করতে হল।
কিন্তু মেয়ের বাবা-মা বলল, সরস্বতী পুজোর দিন ওঁদের নিরামিষ খাওয়া-দাওয়া করতে হয়। তাই ওদিন তাঁরা পাত্রপক্ষকে বাড়িতে আমন্ত্রণ জানাতে চান না। উত্তরবঙ্গের ওসব এলাকায় আবার বাড়িতে অতিথি এলেই মাংসভাত খাওয়ানোর নিয়ম। পুরনো রীতি। সেই পুরনো রীতি আছে বলেই হয়তো আমি পালকিতে বিয়ের ব্যাপারটা পেয়েছি। অসম্ভব বিনয়ের সঙ্গে বললাম – ওসব নিয়ে কিস্যু ভাববেন না। পাত্রর বাবা-মা এমনকী খোদ পাত্রকে আমিই সব বুঝিয়ে বলব। কেন নিরামিষ খাওয়াল – সেই দোষে বিয়ে ভাঙবে না। আপনারা নিশ্চিত থাকুন।
কিন্তু তারপরেও দেখি পাত্রীর বাবা-মা গাইগুঁই করছে। শেষে বলেই ফেললাম – হয় সরস্বতী পুজোর দিনে মেয়ে দেখা হবে। নতুবা এই বিয়ে হবে না। আপনারা কোনটা চান?
এবার দেখি মেয়ের বাবা-মা নরম হল। বলল, এত করে যখন বলছেন – নিয়ে আসুন তাহলে। তবে ঘটক মশাই আপনার সঙ্গে একটা কথা আছে। সেটা কিন্তু আপনাকে একটু মানিয়ে নিতে হবে। হাজার হোক আমার মেয়ে তো আপনার মেয়ের মতোই – কী বলেন?
সবপক্ষকে রাজি পেরে সত্যিই আমারও মনে হচ্ছিল, ঘটকগিরি করলে মন্দ হতো না। যাক গে, শেষ পর্যন্ত সরস্বতী পুজোর দিনই গেলাম গিয়ে সেই মেয়ের বাড়ি। আদর-আপ্যায়ন দারুন হল। মেয়ের বাড়িতে সরস্বতী পুজো। তাই যা ভোগ রান্না হয়েছে তাই দিয়ে অতিথি আপ্যায়ন হবে। তবে তার সঙ্গে বাড়তি আরও কিছু পদ এবং মিস্টি-মিস্টান্নর ব্যবস্থা করা হয়েছে। মেয়ের বাবা আমাকে আগেই একথা বলেছিলেন। আমিও ছেলের বাবাকে সব কথাই খুলে বলেছিলাম। তবে পল্টুর বাবা একটাই আব্দার ধরেছিল – মেয়ে যেন নিজের হাতে খিচুড়ি রান্না করে। সেকথা মেয়ের বাবাকে আগেই বলা হয়েছে।
পুজো শেষে পাত পেড়ে সবাই খিচুড়ি খেতে বসলাম। আমার ডাইনে পল্টু, বায়ে পল্টুর বাবা। তারপর ওর মা। মেয়ে বাড়ির লোকেরা আমাদের তিনজনের আলাদা করে খাওয়ার ব্যবস্থা করেছে। পল্টুরও ব্যাপারটা বেশ পছন্দ হয়েছে। আগেই বলেছি, ও ছোড়া একটু অন্য ধরণের।
পাতে গরম খিচুড়ি পড়ল। সঙ্গে কিছু ভাজাভুজি আর বেশ খানিকটা তরকারি। পল্টুর মা বলে উঠল – ওমা, খিচুড়িতে এত তরকারি কেন? খিচুড়ি তো এমনই সব্জিতে ভরতি। আমি বললাম – বৌদি, চিন্তা নেই। ওই তরকারি ঠিক আপনার কাজে লাগবে। দেরি না করে শুরু করুন। বাড়িও তো ফিরতে হবে। নাকি আজ এখানে থেকে যাওয়ার কথা ভাবছেন?
বেশ একটা হাসি-রসিকতা দিয়েই খিচুড়ি আহার শুরু হল। পল্টুর বাবা পাত থেকে এক খাবলা খিচুড়ি মুখে পুড়েই মুখটা কেমন বেঁকিয়ে নিল। আমি জানতাম। এটাই হবে। মেয়ের বাবা আমাকে আগেই বলেছিল – পাত্রীর সব ভাল। কিন্তু রান্নায় নুনের মাপটা এখনও ঠিক করে আন্দাজ করতে শেখেনি। এর আগের দিন আমি এসে দিব্যি বাড়ির পুকুরের সুন্দর মাছের ঝোল খেয়েছিলাম। নুন একদম ঠিকঠাক ছিল। কিন্তু আজ হয়েছে খিচুড়ি। সরস্বতী পুজোর ভোগ। ভোগ রান্নায় তো আর আগে থেকে চেখে দেখা যায় না। মাছের ঝোল চেখেই সেদিন নুনের পরিমাণ ঠিক করেছিল মেয়ে। আজ আর উপায় নেই। ধরা পড়তেই হবে। তাই মেয়ের বাবা আগেই আমাকে বলেছিলেন সেকথা।
পল্টুর বাবা মুখ ব্যাজার করতেই আমি বললাম, দাদা আপনাকে আগেই বলেছিলাম মেয়ে নুনে গুণে সরস্বতী। সেদিন আপনি রসিকতা ভেবেছিলেন। এবার বুঝলেন তো? নুনটা ঠিক ঠাক আন্দাজ মতো দিতে পারেনা আপনার হবু বউমা। চেখে নিয়ে তবেই দেয়। কিন্তু আজ ভোগ রান্নায় সেটা করতে পারেনি। তাই এই অবস্থা। পাতে কী একটু নুন দিতে বলব?
সারা বাড়িতে একসঙ্গে সবাই চুপচাপ। মেয়ে লজ্জায় ঘরে খিল দিয়েছে। মেয়ের বাবা-মা মাথা নীচু করে অপেক্ষায় রয়েছে ছেলের বাবা কী বলে। বাইরে কোথায় যেন শুধু বাজছে – পালকিতে বউ চলে যায় হায়রে, শরমে মন ভরে যায়।
কতক্ষণ এভাবে কেটেছিল জানিনা। শেষে পল্টুই বলল, খিচুড়িতে নুনটা কম ঠিকই কিন্তু তরকারিতে নুন বেশি। দুটো একসঙ্গে মেখে নিলেই দারুন ব্যালেন্স হয়ে যাচ্ছে। বাবা তুমি তরকারিটা দিয়ে খিচুড়ি মেখে খাও। খাসা লাগবে।
ওদিকে পল্টুর মা মানে বৌদিও বলে উঠল – এই বয়সে ওঁর নুন কম খাওয়া ভালো। পেসারটাও তো রয়েছে। ও বৌমা কোথায় গেলে? এদিকে আসো। তোমাকে বাপু ব্যালেন্স করতে হবে না। তুমি বরং একটু তরকারিতে নুন কমই দিও। দরকার পড়লে আমরা পাতে নুন নিয়ে বসব।
বৌদির এমন কথাতে গোটা বাড়িতে হাসির রোল পড়ল। আমিও হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। এবার বিয়ের দিন বেহারাগুলো একটা ভালো পালকি নিয়ে এলেই হলো।
(কপিরাইট – পারফেক্ট পলিটিক্স)