মঙ্গলবার, ডিসেম্বর 17, 2024
মঙ্গলবার, ডিসেম্বর 17, 2024
Homeপাঁচফোড়নমিউনাস নাট্যসংস্থার রাতব্যাপী নাট্যমহাযজ্ঞ

মিউনাস নাট্যসংস্থার রাতব্যাপী নাট্যমহাযজ্ঞ

- Advertisement -

দেবা রায়

টানা ২৪ ঘণ্টা ধরে পর পর ২৫টি নাটক নিয়ে এক নাট্য মহাযজ্ঞের আয়োজন দেখলো কলকাতার নাট্যমোদি মানুষ। গত শনিবার বিকেল ৩টের সময় উদ্বোধন থেকে রবিবার সন্ধ্যা অতিক্রান্ত হয়ে মোট ২৯ ঘণ্টা নাট্য যাপন হল কলকাতার তপন থিয়েটারে। কলকাতার সরকারী রঙ্গমঞ্চে যেখানে সরকারি অনুপ্রেরণা বা উদ্যোগে চলছে নাট্য মেলার মতো আর একটা নাটকের উৎসব, সেখানে কলকাতারই একটি নিয়মিত নাট্যচর্চা করা নাট্যদল ‘মিউনাস নাট্যসংস্থা’ তাদের নিজেদের সাংগঠনিক দৃঢ়তা ও ক্ষমতাবলে আয়োজন করার সাহস দেখালো। অনেকগুলো দিক থেকে এই উৎসবকে ঐতিহাসিক বলা যায়। অনেক নাট্য ব্যক্তিত্ব সেটা বলছেনও।

প্রথমত টানা ২৪ ঘণ্টা নাট্যাভিনয় করা। ২৪ ঘণ্টায় ২৫টি নাটক দর্শনের আয়োজন করা। জেলা অসংখ্য নাট্যদল যারা কলকাতায় এসে কাজ করা থেকে অনেক দূরে তাঁদেরকে এই মহাযজ্ঞে স্থান করে দেয় মিউনাস। নি:সন্দেহে এই আয়োজনের ফলে সমস্ত অঞ্চলের সাংস্কৃতিক আদান প্রদানের একটি সুযোগ তৈরি হয়। টানা ২৪ ঘণ্টা নাট্য যাপন যখন তাঁদের উদ্দেশ্য তখন খুব স্বাভাবিকভাবেই একটি রাত জেগে নাটক দেখার ভাবনা এসে যায়। এবং পরদিন একটি সকাল ধরা যাক সময়টা সকাল ৬.৩০ টা কিংবা ৭ টায় নাট্যভিনয়। নাট্যকর্মীদের কাছে এ এক রোমাঞ্চকর ভাবনা। সারা রাত রাত জেগে নাটক দেখবেন, তারপর সকালে মঞ্চ ছেড়ে প্রেক্ষাগৃহের সন্মুখে থাকবে পথনাটকের একটি দল ও তাঁদের প্রযোজনা। যাঁরা রাত জেগে নাটক দেখেছে তারা তো এর নাটকের দর্শক হবেনই, এর সঙ্গে যুক্ত হবেন সকালে রাস্তায় চলাফেরা করা মানুষ।

ঝাড়ুদার থেকে প্রাত:ভ্রমণকারী সকলেই দাঁড়িয়ে যান এই আয়োজনে। ভাবুন রাসবিহারি অঞ্চলে তপন থিয়েটার প্রাঙ্গন নাটক দেখার জন্য মানুষ সেই কাকভোড়ে দাঁড়িয়ে নাটক দেখছেন। থিয়েটারে একে কিভাবে বিশ্লেষণ করবেন সেটা আগামীর জন্য তোলা থাক। এবারের এই নাট্য আয়োজন উৎসর্গ করা হয়েছে বাংলা প্রথম মৌলিক নাট্যকার রাম নারায়ন তর্কালঙ্কার এর জন্ম দ্বিশতবর্ষকে মাথায় রেখে। উৎসব ছিল ২৫ ও ২৬ ফেব্রুয়ারী। কিন্তু এই সংস্থার  আরো একটি পদক্ষেপ দৃষ্টান্ত তৈরি করল। ২৪ তারিখে তারা আয়োজন করলেন  বাংলা নাট্যকারদের সমাবেশে ‘ নাট্যকাররা কি অবহেলিত?’ শীর্ষক এক আলোচনাচক্র। যাতে উপস্থিত ছিলেন চন্দন সেন, শ্যামল চন্দ, মৈনাক সেনপগুপ্ত প্রমুখ নাট্যকাররা।

আলোচনা সভা জমে ওঠে নাট্যকারদের অভিজ্ঞতা ও ভাবনার সংলাপে। অবহেলার নানান অজানা তথ্য উত্থাপন ও জ্ঞপনে সভা মুখর হয়ে ওঠে। প্রতিভাত হয় দীর্ঘকালীন একটি অনৈতিক চর্চার। নাট্যকাররা কেন থাকে প্রচারের আড়ালে? কেন তাদের যথোচিত সম্মান দেওয়া হয় না। নাট্যকারদের কোনো আর্থিক সহায়তা তো কেউ করেনই না, বরং তাদের নামটি তাদের প্রচার পত্রে রাখতে ভুলে যান। তদোপরি নির্দেশক নাট্যকারের অনুমতি বা আলোচনার ধার না ধেরে তার খূশী মতো নাটকের সংলাপ চরিত্র সম্পাদনা করেন। এখানেও নাট্যকারদের তরফে ক্ষোভের প্রকাশ ঘটেছে। আবার তারা যে আমাদের নাট্য চর্চায় কত আদরনীয় সেটাও প্রকাশ পেয়েছে। সব মিলিয়ে এই আয়োজনেও মিউনাস তাদের মৌলিকত্ব বজায় রেখেছে। ২৪ ঘণ্টার নাটকের উৎসবের আগে এরকম একটি সূচনা নাট্য আয়োজনকে অনেকটা এগিয়ে নিয়ে যায়।

২৪ তারিখ উদবোধনী অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন হিরণ মিত্র, ড: শুভ জোয়ারদার, প্রবীর গুহ, অরূপ রায় প্রমুখরা। উদবোধনী নাটক ছিল রাম নারায়ন তর্কালঙ্কার রচিত ‘যেমন কর্ম তেমন ফল’ এই পুতুল নাটক দিয়ে। যা উপস্থাপীত ও মঞ্চায়ন করেছে ‘বঙ্গপুতুল’  পুতুল নাট্য সংস্থা। চিত্রকর হিরণ মিত্র এই আয়োজনকে সাধুবাদ জানিয়ে বলেন এই আয়োজন জেলার নাটক দেখার সুযোগ থাকছে। সকলের এই আয়জনে সাক্ষী থাকা দরকার। নাট্য গবেষক ড: শুভ জোয়ারদার বলেন এরকম একটি ঘটনা পৃথিবীর আর কোথাও ঘটেছে কি না তাঁর জানা নেই। নি:সন্দেহে গিনেস গুকে নাম ওঠার মতো কাজ। অনীক নাটদলের নির্দেশক অরূপ রায় বলেন এখানে এই মহত অনুষ্ঠানে দর্শকের ভূমিকা সবচেয়ে বেশী যে থিয়েটার কর্মীরা তাদের নিজেদের জীবন বিপন্ন করে নাটকের উৎসব  করছেন তাদের পাশে সকল থিয়েটার কর্মীদের থাকা উচিত।  নাট্য ব্যক্তিত্ব প্রবীর গুহ বলেন এই আয়োজন নাট্যকর্মীদের কাছে এক মহতী উদ্যোগ।

এই নাট্য মহাযজ্ঞে যে নাট্যদলগুলি তাদের প্রযোজনা করেছেন তাদের কথা আলাদা করে বলার অপেক্ষা রাখে না। নাটক চলাকালীন নানা অভিব্যাক্তি আর মন্তব্যই সেই নাট্যসন্ধ্যাকে ঋদ্ধ করেছে। আমরা দেখেছি বহু মানুষকে যারা নাটক দেখতে ভালোবাসেন, তারা দর্শকাসনে থেকেছেন বিকেল থেকে রাত গড়িয়ে সকাল আবার সন্ধ্যে পর্যন্ত। তারা কি পেয়েছেন জানি না তবে তাদের জীবনে চব্বিশ ঘন্টা বা উনত্রিশ ঘন্টা কোথাও না কোথাও তাদের সংবেদনশীলতায় নাড়া দেবে এই আয়োজন। নাটকগুলির বিষয়বস্তু ও উপস্থাপনায় মুগ্ধ হয়ে তারা করতালিতে উৎসব সার্থক করেছেন।

এই আয়োজনের মাস্টার প্ল্যানার দলেরই কর্ণধার উৎসব দাস সম্পর্কে দু এক কথা না বললে অসম্পূর্ণ থেকে যায়। নাটককে ভালোবেসে সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতা থেকে তার আই ভাবনা নাট্য সমাজকে একসাথে চলার বার্তা দিয়েছে। আমরা যেখানে দলগত ক্যারিস্মা প্রদর্শনে ডুবে আছি,  যেখানে নিজেরটা ছাড়া কিছুই বুঝি না, সেখানে এই মানুষটি নিজেদের প্রযোজনার সাথে সাথে এরকম একটি ঐতিহাসিক ব্যাবস্থাপনার আয়োজন করতে পারেন, তা ভাবায় বই কি। উৎসব বাবু বলেন, ‘নিজেদের থিয়েটার চর্চার পাশাপাশা জেলা বা নিজের শহরের দলগুলিকে একসাথে নিয়ে এসে ২৪ ঘন্টা কাটাতে পারলে আমার থিয়েটার যাপন সার্থক হয়।’ 

এই আয়োজন প্রতিবছর হোক। আরো নতুন দল সেখানে স্থান পাক, থিয়েটারের এই মহাযজ্ঞ সার্থক হবে দর্শকানুকুল্যে। দর্শককে আরো বেশী করে আসতে হবে। 

আরও খবর
- Advertisment -

সবাই যা পড়ছেন

পছন্দের খবর