অনির্বান দে
একটা কথা আপনাদের মানতেই হবে। মমতা ব্যানার্জীর এলেম আছে বটে। যেভাবে তিনি দুর্নীতির অভিযোগের বিরুদ্ধে লাগাতার লড়াইটা দিয়ে যাচ্ছেন এবং হাসিমুখে এদিক-ওদিক ঘুরে বেড়াচ্ছেন – তাতে হাততালি না দিয়ে উপায় নেই। অন্য কোনও নেতা হলে এতদিনে স্যারেন্ডার করে ঘরে ঢুকে খিল দিত। কিন্তু বলিহারি মমতার, তিনি শুধু মাথাউঁচু করে বিরোধীদের সঙ্গে লড়াইটা চালাচ্ছেন তাই নয়, বীরত্বের সঙ্গে নিজের কাজের ফলাও প্রচারও করছেন। তবে হাততালির কিছুটা মমতা অ্যান্ড কোং-এর জন্যেও তুলে রাখা উচিত। কেননা, কুণাল ঘোষ, ব্রাত্য বসু এবং জেলবন্দি পার্থ চট্টোপাধ্যায় যেভাবে দলনেত্রীর তালে তাল দিয়ে খেলাটা খেলে যাচ্ছেন – ওহ ব্র্যাভো! আর কিছুর জন্য না হোক, তৃণমূল সরকারের এমন লড়াইটা নিশ্চয় বাঙালিরা অনেকদিন মনে রাখবে।
এই মুহূর্তে রাজ্য রাজনীতিতে দুর্নীতির প্রসঙ্গ তুললে নিজের মুখ থেকেই গন্ধ বেরোবে। কিন্তু উপায় নেই। ধাপার মাঠে বাস করে তো আর সমুদ্রের সুগন্ধ পাওয়া যাবে না! সুতরাং দুর্নীতি নিয়েই যখন আমাদের ঘর – দুর্গন্ধের কথা বলা বাতুলতা। তাও বলতে হয়। কারণ, এছাড়া এখন বাঙালির আলোচনার বিষয় আর কি আছে? আমরা তো আর নাটু নাটু গান লিখে অস্কার পাওয়ার স্বপ্ন দেখিনা, রাশিয়া-ইউক্রেনের যুদ্ধের বিরুদ্ধেও রাস্তায় নামি না। অতএব আমাদের যত আলোচনা চাকরি আর দুর্নীতি নিয়ে। কিন্তু সেই আলোচনা কোথা থেকে শুরু হবে? যত তদন্ত হচ্ছে এই তৃণমূল সরকারের আমল নিয়ে। কিন্তু সেটা কি ঠিক হচ্ছে? এই প্রশ্নটাই এখন রাজ্যের মানুষকে খাওয়ানোর চেষ্টা করছেন কুণাল ঘোষ, ব্রাত্য বসুরা।
তাঁদের কথায়, চাকরিতে নিয়োগ দুর্নীতি নতুন কথা নয়। সেই সিপিএম আমল থেকেই চলে আসছে। সিপিএম আমলে চিরকূট দিয়ে মাস্টারি চাকরি হয়েছে। সেই সময় যদি চিরকূট দিয়ে মাস্টারি চাকরি হয়ে থাকে তাহলে তৃণমূল আমলে ওমএমআর সিট পালটে শিক্ষক নিয়োগ করে কোন মহাভারতটা অশুদ্ধ হয়েছে? এমন অকাট্য যুক্তি নিশ্চয় কুণাল ঘোষ কিংবা ব্রাত্য বসুরা অনেক ভেবে বের করেছেন। তা না হলে এই যুক্তিটা তাঁরা এত দেরিতে দিতেন না। যদিও শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসুর দাবি, মুখ্যমন্ত্রী ২০১১ সালে বাংলার ক্ষমতায় আসার পরই বলেছিলেন – ‘বদলা নয় বদল চায়’ – সেই কারণেই না কি সিপিএম আমলে কে কিভাবে চাকরি পেয়ে লাখ লাখ টাকা মাইনে নিয়েছেন, কেই বা এখন বুড়ো হযে ঘরে বসে হাজার হাজার টাকা পেনশন নিচ্ছেন, সেসব কিছু দেখা হয়নি।
কিন্তু এখন যেহেতু চাকরির নিয়োগ নিয়ে তদন্ত চলছে, এবং সেই তদন্ত নিয়ে সিপিএম নেতারা তৃণমূলকে আক্রমণ করছে – সুতরাং এবার প্যান্ডোরার বাক্স খোলার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। এবং এখন পর্যন্ত সেই প্যান্ডোরার বাক্সে সবার আগে যে নামটি বেরিয়েছে তাঁর নাম সুজন চক্রবর্তী। সুজন চক্রবর্তীর স্ত্রী মিলি চক্রবর্তী এখন ঘরে বসে পেনশন নেন। হাজার হোক পেনশনটা তো তৃণমূল সরকারের। সুতরাং তৃণমূল সরকারের পেনশন নেবেন আবার তাঁর স্বামী সেই তৃণমূল সরকারকেই খোঁটা দেবেন – এটা তো চলতে পারে না। সুতরাং খোঁজ খোঁজ। কী করে এই মিলি চক্রবর্তী চাকরিটা পেয়েছিল? কী করে শিক্ষকতায় ঢুকেছিল?
শিক্ষা দফতরের এক কোনে পড়ে থাকা বাম আমলের ধূলো পড়া ফাইল গুলো ঝেড়ে কয়েকটা চিরকূটও পাওয়া গেল। তাতে মিলি চক্রবর্তীর নামটাও বেরিয়ে এল। অতএব হুররে বলে লাফ দিয়ে শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসু রীতিমতো সাংবাদিক বৈঠক করে বসলেন। এবং সাংবাদিক বৈঠকে হুঙ্কার ছেড়ে বললেন, আছে আছে সব আছে। সিপিএম আমলে কী হয়েছিল, হরিদাস পাল সুজন চক্রবর্তীর স্ত্রী কি করে চাকরি পেয়েছিল – সব খুঁজে পাওয়া গিয়েছে। এবার শুধু মুখ্যমন্ত্রীর ইশারার অপেক্ষা। তারপরই বাম আমলে চিরকূট চাকরির শ্বেতপত্র প্রকাশ!
ব্রাত্য বসু কিংবা কুণাল ঘোষদের ইঙ্গিত স্পষ্ট, সিপিএম আমলে যেহেতু চিরকূট চাকরি নিয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কিছু বলেনি, তৃণমূল সরকার যখন তদন্ত করেনি, তাহলে তৃণমূল আমলের চাকরি দুর্নীতি নিয়ে সিপিএম গলাবাজি করছে কেন? এখন বুঝবে দুর্নীতি কাকে বলে! কে বেশি দুর্নীতি করেছে! ব্রাত্য কিংবা কুণালদের এই কথাগুলো নতুন কিছু নয়। এর আগে খোদ তৃণমূল নেত্রীও এই চিরকূট চাকরি নিয়ে আকারে-ইঙ্গিতে সিপিএমকে বহুবার হুঁশিয়ারি দিয়েছিলেন। কিন্তু ‘মাথামোটা’ সুজন চক্রবর্তীরা মানে বোঝেন নি। যেমনটা মানে বোঝেন নি ‘বদলা নয় বদল চায়’-এর। ওরে বোকা, বদলা মানে কি শুধুই মারপিট? খুন-খারাপি? তুমি দুর্নীতি করেছ, আমি সেই দুর্নীতির কথা লোককে জানিয়ে দিলাম – সেটাও তো বদলা!
এখন সুজন চক্রবর্তীর মতো কাস্তে হাতুড়ে মার্কামারা নেতাদের চুল সাদা হয়ে গেলে কী হবে! বদলা শব্দটার মানেটাই তাঁদের মাথায় ঢোকেনি। ঢোকেনি বলেই তো ওই ‘মিরজাফর’ শুভেন্দু অধিকারীর সঙ্গে তালে তাল মিলিয়ে দুর্নীতি দুর্নীতি করতে গেছে। এবার বোঝ ঠ্যালা কাকে বলে। সুজনের ‘পাপে’ আর কোন কোন কাস্তে হাতুড়ে মার্কা নেতাদের বউ-বাচ্চা-মেয়ে-জামাই-ভাই-ভতিজাদের চাকরি নিয়ে টানাটানি হবে – কে জানে! সিপিএম আমলে খুন হওয়াদের কঙ্কাল পুলিশ আগেই কিছু কিছু জায়গায় বের করেছে। কিন্তু এবার সিপিএম আমলে চাকরির কঙ্কালও বের হবে। কুণাল ঘোষ ঠিকই বলেছেন, সিপিএম নেতা সুজন চক্রবর্তী কাঁচের ঘরে বসে ঢিল মেরে বড্ড ভুল করেছে।
(প্রবন্ধের বক্তব্য একান্তই লেখকের নিজস্ব)
লেখক পরিচিতি – অনির্বান দে একজন শিক্ষক। উত্তরবঙ্গের রায়গঞ্জে তিনি কর্মরত। বিভিন্ন রাজনৈতিক বিষয় নিয়ে বরাবরই তিনি সোশাল মিডিয়ায় নিজের মতামত দিয়ে থাকেন।