আচার খেতে ভালোবাসেন না এমন মানুষ খুব কমই আছেন। ছোট বেলায় শীতের দুপুরে মা-দিদারা যখন আয়েশ করে মিষ্টি রোদে একটু ঝিমিয়ে নিচ্ছেন সেই ফাঁকে আচার (pickles) চুরি করে খাওয়ার অপূর্ব স্বাদ আজও অনেকের জিভের ডগায় লেগে আছে। কিন্তু শীতের সময় টক খাওয়া কি আদৌ স্বাস্থ্যের পক্ষে ভালো না কি ক্ষতিকর?
কেননা, সেই ছোটবেলাতেই অনেককে আবার এও শুনতে হয়েছে – এত নোলা ভালো নয়। অনেক বড়রা ছোটদের এও বলতেন, ঠান্ডায় আচার খাওয়া ভালো নয়। এতে জ্বর, সর্দি-কাশি হতে পারে। সত্যিই কি তাই?
আসলে গবেষণা বলছে, আমাদের মস্তিষ্কের মধ্যে যে ওপিনওয়েড সিস্টেম থাকে তার গুণেই লবনাক্ত খাবার গ্রহণের চাহিদা বৃদ্ধি পায়। এছাড়াও আচার তৈরি হয় নুন, লেবু, হলুদ মাখিয়ে শুকনো করার পর। এরপর এতে মেশানো হয় তেল, ভাজা মশলা।
সব মিলিয়েই আচারের (pickles) প্রতি আমাদের আসক্তি আসে। শরীরে জলের ঘাটতি, ইলেকট্রোলাইটের ভারসাম্যহীনতা অথবা এডিসন রোগের কারণে মানুষের আচার খাবার প্রবণতা (Pickles Benefits) চোখে পড়ে। এক কথায় বলতে গেলে – সাধারণ দেশি ঘরোয়া আচারের যে রেসিপি তার মধ্যে খারাপ কিছু নেই।
ফলে আচারের সবচেয়ে ভালো দিক হল, এই জিনিস সব বয়সের মানুষের জন্য উপকারী। এগুলি বিভিন্ন খাবারে শুধু স্বাদ এবং সুগন্ধই যোগ করে না, এগুলিতে প্রচুর পরিমাণে পুষ্টিও (Pickles Benefits) রয়েছে। তাই বেশিরভাগ লোকেরা শীতের মরসুমে বাঁধাকপি, মুলো এবং গাজরের আচার খেতে পছন্দ করেন।
সেলিব্রিটি পুষ্টিবিদ রুজুতা দিওয়াকরের মতে, শীতের আচার ত্বক, অন্ত্র এবং জয়েন্টের ব্যথা নিরাময় করতে পারে।
আচার (pickles) হল ভিটামিন আর মিনারেলের ভান্ডার
আচার যেহেতু প্রাকৃতিক উপাদান দিয়ে তৈরি হয় তাই এর মধ্যে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট, প্রয়োজনীয় ভিটামিন এবং মিনারেলও পাওয়া যায়। এছাড়াও এটি রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানোর একটি ভালো উপায়। স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মতে, আমলা এবং মুলার আচারে হেপাটোপ্রোটেকটিভ বৈশিষ্ট্য থাকায় এটি হজমের জন্য খুবই উপকারী।
আচার (pickles) ডায়াবেটিস ও লিভারের রোগে উপকারী
পুষ্টিবিদদের মতে, শীতকালে আচার ডায়াবিটিসে আক্রান্তদের হিমোগ্লোবিনের মাত্রা ভালো রাখতে সাহায্য করে। তাই লিভারের রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিদের খাদ্যতালিকায় আমলা এবং মূলার আচার অন্তর্ভুক্ত করা উচিত।
রোদে তৈরি করা আচার (pickles) অমৃত
ঘরোয়া আচার সাধারনত রোদে রেখে তৈরি করা হয়। রুজুতা দিওয়াকরের মতে, সূর্য়রশ্মির সংস্পর্শে থাকার কারণে আচারের উপাদন পুষ্টিগুণ সম্পন্ন হয়। যা মেটাবলিজম বাড়াতে সাহায্য করে। আচার মশলার সঙ্গে সরষের বীজ মিশ্রিত শ্বাসযন্ত্রের রোগের জন্য একটি ঐতিহ্যগত থেরাপি।তাছাড়া, শীতের মরশুমি ফল দিয়ে তৈরি আচার যেহেতু এক্কেবারে টাটকা থাকে ফলে তার মধ্যে পুষ্টিগুণ অনেকবেশি থাকে।
খাঁটি সরষে তেলের ঘরোয়া আচার (pickles)
তবে, আচার খেতে যতই ভালোবাসুন না কেন, একটি কথা কিন্তু মাথায় রাখতে হবে – আর সেটি হল, যতটা পারবেন ঘরোয়া আচার খাওয়ার চেষ্টা করবেন। কেননা, এতে তেমন কোনও কৃত্রিম জিনিস মেশানো হয়না। কিন্তু কোনও কোম্পানির আচার যেহেতু অনেক বেশি পরিমাণে বাজারজাত করার জন্য তৈরি করা হয় ফলে তাতে এমন কিছু জিনিস মেশানো হয় যাতে ওই আচার বহুদিন পর্যন্ত ঠিক থাকে। তাছাড়া, বাজারজাত আচার রোদে তৈরি করা হয় না। পুরোটাই কৃত্রিম পরিবেশের মাধ্যমে তৈরি করা হয়। ফলে সেই আচার খেলে অনেকের ক্ষেত্রে নানান সমস্যা দেখা দিতে পারে বলে সাবধান করে দিচ্ছেন রুজাতা দিওয়াকরের মতো পুষ্টিবিদরা।
ঘরোয়া আচার (pickles) তৈরির রেসিপি
আমের আচার (pickles recipe)
আমের আচার খেতে ভালোবাসে না এমন মানুষ বোধহয় খুঁজে পাওয়া যাবে না। বর্তমানে কাঁচা আম প্রায় সারাবছরই পাওয়া যায়। ফলে চাইলে শীতের সময়েও দিব্যি আমের আচার তৈরি করা যায়। ফলের রাজা আমের আচার যেহেতু অত্যন্ত সুস্বাদু সুতরাং তার রেসিপিটাই প্রথমে বলি –
প্রথমেই কাঁচা আমগুলিকে ছোট ছোট কিংবা ডুমো ডুমো করে কেটে নিন। এরপর ভালো করে জলে ধুয়ে কিছুক্ষণ রোদে দিয়ে জল শুকিয়ে নিন। এরপর পরিমাণ মতো লবন ও হলুদ মিশিয়ে আবার শুকোতে দিন। কেননা, নুন মেশানোর পরই কিন্তু জল বেরোতে শুরু করবে। সেই জল রোদে শুকিয়ে নিন।
দু’তিন দিন প্রায় ঘণ্টা পাঁচেক করে রোদে শুকনোর পর আমের টুকরোগুলি কালচে হয়ে আসতে শুরু করবে। এইবার তাতে পরিমাণ মতো গোটা সরষে, মৌরি, মেথি, জিরের গুঁড়ো ভালো করে মিশিয়ে নিন। আবার একদিন রোদে শুকোতে দিন। এরমাঝে আদা, রসুন, শুকনোলঙ্কা, গোলমরিচ, সরষে, কালোজিরে, অল্প চিনি দিয়ে বেটে পেস্ট তৈরি করুন। সেই পেস্ট কাঁচা সরষে তেলের সঙ্গে মিশিয়ে ঝোল তৈরি করুন।
সবশেষে শুকনো আমের টুকরোগুলো কাঁচের জারে ঢুকিয়ে এই ঝোল তার ওপর ঢেলে দিন। এরপর টানা কাঁচের জার রোদে রাখতে শুরু করুন। প্রায় দিন পনের পরে দেখবেন আমের টুকরোগুলো নরম হয়ে গিয়েছে। তারমানেই আচার তৈরি হয়ে গিয়েছে। তবে খেয়াল রাখবেন সরষে তেল যেন শুকিয়ে না যায়। আর মাঝে মাঝে অবশ্যই চামচ দিয়ে কাঁচের জার ঘেঁটে দেবেন।
আমড়ার আচার (pickles recipe)
আমড়াকে কিউব করে কেটে শুকনো কাপড় দিয়ে ভালোভাবে ধুয়ে শুকিয়ে নিন।
একটি মিশ্রণের পাত্রে আমড়া, লবণ এবং হলুদ মিশিয়ে নিন। এটি একটি সুতির কাপড়ে স্থানান্তর করুন এবং এটি কয়েক দিনের জন্য সূর্যের নীচে রাখুন।
একটি মিক্সার জারে মেথি, সর্ষন, আজওয়াইন, ম্যাংগ্রাইল এবং সানফ পিষে নিন। আমড়ার সাথে লাল মরিচের গুঁড়ো এবং হিং (হিং) এর সাথে গ্রাউন্ড পাউডার (গরম মসলা) একত্রিত করুন। মিশ্রণের উপরে সরিষার তেল দিয়ে ভালো করে নাড়ুন।
এবার আচারটি একটি বায়ুরোধী কাঁচের বয়ামে রাখুন এবং কয়েকদিন বাইরে রোদে রাখুন। আমড়ার আচার খাওয়ার উপযোগী হয়ে গেলে পরিবেশনের জন্য প্রস্তুত করা হয়।
আমলকির আচার (pickles recipe)
প্রথমে প্রেশার কুকারে পরিমাণ মতো জলে সামান্য নুন দিয়ে সেদ্ধ করে নিন। এর পর বীজ বার করে ম্যাশ করুন। জল আলাদা করে রেখে দিন। এটা চুল এবং ত্বকের পক্ষে খুবই উপকারি। এর পর ১ চা চামচ জিরে, ১ চা চামচ জোয়ান, ৪টে এলাচ, ৬-৭টা গোলমরিচ, ১ টুকরো দারচিনি, ২টো শুকনো লঙ্কা শুকনো খোলায় ভেজে গ্রাইন্ড করুন। ধাতুর পাত্রে আচার তৈরি করলে স্বাদ একটু তেঁতো হয়। মাটির পাত্রে তা হয় না।
এর পর ৩ চা চামচ সরষের তেল, ১টা তেজপাতা, ২টো শুকনোলঙ্কা, ১ চা চামচ মৌরি। এর পর ম্যাশ করা আমলকি যোগ করুন। হালকা আঁচে ৫ মিনিট নাড়াচাড়া করুন। ১ চা চামচ সামুদ্রিক লবন (Sea Salt), ১ চা চামচ বিটনুন ও সেদ্ধ করা আমলকির জল ১/৪ কাপ দিয়ে দিন। এর পর গ্রাইন্ড করা মশলা যোগ করুন ও ১ কাপ গুড় দিন। অর্ধেক হওয়া পর্যন্ত হালকা আঁচে রান্না করুন। এর পর তৈরি অত্যন্ত সুস্বাদু এবং ইমিউনিটি বুস্টার আমলকির আচার।
গাজরের আচার (pickles recipe)
গাজর, কাঁচা মরিচ ও আদা ভালো করে ধুয়ে নিন। পুরোপুরি শুকিয়ে নিন। গাজর ও আদা খোসা ছাড়িয়ে নিন। এবার গাজরগুলিকে 1 ½ ইঞ্চি লম্বা এবং মাঝারি পুরু স্টিকগুলিতে কেটে নিন। খুব বেশি পাতলা করবেন না অন্যথায়, আচার তৈরি হয়ে গেলে এটি শুকনো, নরম এবং ভিজে যেতে পারে। আমরা নরম চাই তবুও কিছু সংকট থাকা উচিত।
সবুজ মরিচ প্রস্তুত করতে, প্রথমে মরিচকে অর্ধেক করে কেটে নিন এবং তারপরে 1 ½ ইঞ্চি লম্বা টুকরো করে কেটে নিন। একই দৈর্ঘ্যের আদার কাঠি তৈরি করুন তবে গাজরের চেয়ে পাতলা রাখুন কারণ আদার একটি শক্তিশালী গন্ধ রয়েছে।
উচ্চ তাপে একটি সসপ্যানে জল একটি ঘূর্ণায়মান ফোড়াতে আনুন। একবার ফুটতে শুরু করলে, গাজর যোগ করুন এবং ঠিক 2 মিনিট রান্না করুন । অবিলম্বে জল নিষ্কাশন.
পরিষ্কার রান্নাঘরের তোয়ালে গাজরের কাঠিগুলি ছড়িয়ে দিন এবং এটি সম্পূর্ণরূপে শুকিয়ে দিন। মানে শেলফ লাইফ বাড়ানোর জন্য তাদের উপর কোন আর্দ্রতা থাকা উচিত নয়। আপনার যদি সূর্যের অ্যাক্সেস থাকে তবে আপনি 1 ঘন্টা সরাসরি সূর্যের আলোতে রাখতে পারেন। অথবা রান্নাঘরের কাউন্টারে ঘরের তাপমাত্রায় 1 দিন বা রাতারাতি শুকাতে দিন। তাড়াহুড়ো হলে, কাগজের তোয়ালে দিয়ে শুকিয়ে নিন। এবার একটি পাত্রে রাই কুড়িয়া, লাল লঙ্কা গুঁড়ো, লবণ এবং চিনি নিন। সবকিছু ভালভাবে মেশান।তেঁতুলের পাল্প যোগ করুন। এছাড়াও, তেল যোগ করুন। আচার মসলা সত্যিই ভালভাবে মেশান। শুকনো গাজর, মরিচ এবং আদা যোগ করুন। ভাল করে মেশান।
প্লাস্টিকের মোড়ক দিয়ে বাটিটি ঢেকে রাখুন এবং ফ্রিজে 1 দিনের জন্য পরিপক্ক হতে দিন। একবার বা দুবার নাড়ুন। দেখবেন সবুজ মরিচের রং গাঢ় হয়ে যাবে। এছাড়াও, তেল উপরে ভাসতে শুরু করবে।
গাজরের আচার পরিপক্ব হওয়ার কয়েকদিন পর আরও ভালো স্বাদ পাবে। বায়ুরোধী, পরিষ্কার, শুকনো কাঁচের বয়াম বা পাত্রে সংরক্ষণ করুন।
গাজরের আচার ৬-৭ মাস রাখার উপায়
- গজার কা আচার একটি পরিষ্কার, শুষ্ক (আদ্রতা-মুক্ত) কাচের পাত্রে বা পাত্রে সংরক্ষণ করুন। এক দিন আগে, জারটি ভালভাবে ধুয়ে ফেলুন, এটি সম্পূর্ণরূপে শুকিয়ে দিন। এক ঘণ্টা রোদের নিচে রাখতে পারেন।
- আচার নিতে সবসময় একটি পরিষ্কার, শুকনো চামচ ব্যবহার করুন।
- আপনি যদি বড় ব্যাচ তৈরি করে থাকেন তবে প্রতিদিনের ব্যবহারের জন্য একটি ছোট বয়ামে কিছু আচার সংরক্ষণ করুন। তাই আপনাকে প্রতিদিন বড় বয়াম খুলতে হবে না এবং এইভাবে এটি এর শেলফ লাইফ বাড়ায়।
- যত তাড়াতাড়ি আপনি প্রয়োজনীয় অংশটি বের করে নিন, অবিলম্বে একটি ঢাকনা দিয়ে জারটি বন্ধ করুন এবং এটি আবার ফ্রিজে রাখুন।
লঙ্কার আচার (pickles recipe)
লঙ্কা প্রথমে ভাল করে ধুয়ে নিন। এরপর শুকিয়ে নিন। তারপর ছবির মতো করে পাতলা পাতলা করে কুঁচিয়ে ফেলুন।
এরপর যে কাঁচের শিশিতে আচার রাখবেন, সেটি গরম জল দিয়ে পরিষ্কার করে ধুয়ে নিন। এবার একটি সসপ্যানে ভিনিগার, চিনি, রসুন, সাদা জিরে ও ২ কোয়া রসুন দিয়ে দিন। পুরো ব্যাপারটা ফুটতে শুরু করতে দিন। এই তরলটাই আপনার লঙ্কার আচারের মিডিয়াম বলতে পারেন। এর থেকে স্বাদ ও সংরক্ষণের কাজ হবে।
মিশ্রণটি ফুটতে শুরু করলে গ্যাস নিভিয়ে দিন। এরপর কেটে রাখা লঙ্কা তার মধ্যে ঢেলে দিন। এবার লঙ্কা ও মিশ্রণ একসঙ্গে স্বাভাবিক তাপমাত্রায় আসতে দিন। দেখবেন ধীরে ধীরে লঙ্কার রঙ আচারের মতো হচ্ছে।
মিশ্রণ প্রায় স্বাভাবিক তাপমাত্রায় এসে গেলে ধুয়ে রাখা শিশিতে ঢেলে ফেলুন। লঙ্কা কুঁচি যাতে সম্পূর্ণভাবে তরলে ডুবে থাকে, তার খেয়াল রাখবেন। বানানোর সঙ্গে সঙ্গেই খেতে পারবেন এই লঙ্কার আচার। একবার বানালে ১ মাস পর্যন্ত ফ্রিজে রাখা যাবে এই লঙ্কার আচার।
দুর্দান্ত মিষ্টি, টক, ঝাল স্বাদ পাবেন। মুড়ি মাখা, ডাল-ভাত, চাউমিন, ম্যাগি, চিজ টোস্ট ইত্যাদির উপর অল্প করে নিয়ে খেতে পারেন।
জলপাইয়ের আচার (pickles recipe)
জলপাই ২/৩ মিনিট ফুটন্ত পানিতে সিদ্ধ করে নিন। পরে লবণ, হলুদ মাখিয়ে কিছু সময় রৌদ্রে শুকিয়ে নিন। একটি বাটিতে হলুদ, মরিচ, ধনে গুঁড়া, লবণ, চিনি, সরিষা বাটা, সিরকা দিয়ে পেস্ট তৈরি করে নিন। কড়াইতে সরিষার তেল দিয়ে শুকনা মরিচ ও রসুনের ফোড়ন দিন। পরে মসলা পেস্ট দিয়ে সামান্য ভাজুন। জলপাই দিয়ে নাড়াচাড়া করুন। নামানোর আগে চুলার তাপ কমিয়ে সোডিয়াম বেনজুয়েট দিয়ে নেড়ে নামিয়ে নিন। তৈরি হয়ে গেল জলপাইয়ের রসালো আচাড় বা জলপাইয়ের টক আচার।