তথাগত সিংহ
কালীঘাটের কাকু, ওরফে সুজয়কৃষ্ণ ভদ্র – ইডির হাতে গ্রেফতার হয়েছেন। তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ, নিয়োগ দুর্নীতির কালোটাকা তিনি সাদা করেছেন। ইডি সূত্রে খবর, এ বিষয়ে মঙ্গলবার সুজয়কৃষ্ণ ভদ্রকে বার বার প্রশ্ন করা হলেও কোনও জবাব দেন নি। অর্থাৎ তদন্তে সহযোগিতা করেননি। সুতরাং ইডি সুজয়কৃষ্ণ ভদ্রকে গ্রেফতার করেছে। আর তাঁর গ্রেফতারির পরেই আনন্দে উচ্ছ্বসিত হতে দেখা গিয়েছে রাজ্যের বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারীকে।
সুজয়কৃষ্ণ ভদ্রর ইডির হাতে গ্রেফতারির পরই শুভেন্দু অধিকারী টুইটে লেখেন, ‘‘আইনের লম্বা হাত শেষ পর্যন্ত মাস্টার মাইন্ড এবং সবথেকে লাভবানকারীদের কাছে পৌঁছে গিয়েছে। কাউকেই ছাড়া হবে না। এরপর মাথারাও জেলে যাবেন।’’ স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে শুভেন্দু অধিকারী কার কথা বলতে চেয়েছেন। অন্যদিকে, তৃণমূলের মুখপাত্র কুণাল ঘোষ আবার টুইটে লিখেছেন, ‘‘আসলে বাইরন বিশ্বাস তৃণমূলে যোগ দিতেই অনেকের ঘুম উড়েছে। সেই কারণেই সুজয়কৃষ্ণকে গ্রেফতারের মাধ্যমে নজর ঘোরানোর চেষ্টা চলছে।’’
এই রাজনৈতিক তরজার মাঝে সবথেকে বড় প্রশ্ন হয়ে দেখা দিচ্ছে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় এবং মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের গ্রেফতারি। কেননা, শুভেন্দু অধিকারীর মতো নেতারা বারবার দাবি করে এসেছেন – নিয়োগ দুর্নীতি থেকে শুরু করে গরুপাচার কিংবা কয়লা পাচার, সবকিছুতেই অভিষেক ও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়রা কমিশন পেয়েছেন। তাঁদের ইশারাতেই সমস্ত যত কান্ড হয়েছে। তা না হলে যে তৃণমূল কয়েক বছর আগেও কয়েক কোটি টাকার মালিক ছিল, সেই তৃণমূলের এখন সম্পত্তি কয়েক শো কোটি হয় কী করে?
তৃণমূলের পালটা যুক্তি, দুর্নীতি তেমন কিছু হয় নি। ছোট-খাটো দু’একটা ভুল হয়তো হয়েছে। কাজ করতে গেলে সবারই এমন ভুল হয়। সেটাই হয়তো হয়েছে। কিন্তু বিজেপি ২০২১-এ পশ্চিমবঙ্গ দখল করতে পারেনি বলেই সিবিআই-ইডিকে দিয়ে রাজনৈতিক প্রতিহিংসা নিচ্ছে। আর যেহেতু ভূ-ভারতে একমাত্র মমতা-অভিষেকই বিজেপিকে টেক্কা দিতে পারেন তাই তাঁদেরকেই টার্গেট করা হচ্ছে। সুতরাং এই যে সুজয়কৃষ্ণ ভদ্র, পার্থ চট্টোপাধ্যায়, কুন্তল ঘোষ, তাপস মণ্ডল, মানিক ভট্টাচার্য, গোপাল দলপতি কিংবা অয়ন শীলের গ্রেফতারি – সবাই হচ্ছে এই টার্গেটের ফসল।
কিন্তু তৃণমূলের এই যুক্তি ধোপে টিকে না যখন মাঝখানে হাইকোর্ট এসে পড়ে। হাইকোর্টের নির্দেশ কিংবা রায় এসে পড়ে। এখানে তৃণমূল নেতারা বার বার রাজ্যের মানুষ কিংবা কর্মী-সমর্থকদের বোঝানোর চেষ্টা করছে – যা ঘটছে, যা তদন্ত হচ্ছে সবই নরেন্দ্র মোদী-অমিত শাহদের প্রতিহিংসার ফল। কিন্তু তাঁরা মাঝখান থেকে এই কথাটা পুরোপুরি গিলে ফেলছেন যে সব তদন্তই হচ্ছে হাইকোর্টের আদেশে। অর্থাৎ তৃণমূল নেতাদের যুক্তি মানতে হলে বলতে হয় – কলকাতা হাইকোর্টকে বিজেপি পকেটে পুরে ফেলেছে। এই তত্ত্বটাও যে তৃণমূল পাবলিককে খাওয়ানোর চেষ্টা করেনি তা কিন্তু নয়। করেছিল। অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় এবং কুণাল ঘোষরা হাইকোর্টের বিচারপতিদের কয়েকজনকে ব্যক্তিগত আক্রমণ করা শুরু করেছিলেন। এমনকি তৃণমূলপন্থী আইনজীবীরা সেই বিচারপতিদের এজলাসও অচল করে দেওয়ার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু অল ইন্ডিয়া বার কাউন্সিল সক্রিয় হয়ে উঠতেই তৃণমূলকে গুটিয়ে যেতে হয়।
এতকিছুর মাঝেই, এত বদনাম নিয়েই কলকাতা হাইকোর্টের নির্দেশে ইডি-সিবিআই তদন্ত চালিয়ে যাচ্ছে। আর একের পর এক জন গ্রেফতার হতে হতে এখন কালীঘাটের কাকু মানে সুজয়কৃষ্ণ ভদ্র পর্যন্ত পৌঁছে গিয়েছে। প্রশ্ন হচ্ছে, কে এই সুজয়কৃষ্ণ ভদ্র? উত্তরে বলতেই হয় – ভদ্রলোককে আগে কখনো কেউ দেখেনি। কেউ তাঁর নাম জানতও না। কিন্তু তাঁর নাম প্রথম প্রকাশ্যে আসে নিয়োগ দুর্নীতিতে গ্রেফতার তাপস মণ্ডলের মুখে। তারপরই কুন্তল ঘোষও এই কালীঘাটের কাকুকে নিয়ে রহস্য তৈরি করেন। এবং সেই শেষ পর্যন্ত সেই রহস্যের জাল কাটতেই কালীঘাটের কাকু হিসেবে সুজয়কৃষ্ণ ভদ্র বেরিয়ে পড়েন।
আর প্রকাশ্যে আসতেই সুজয়কৃষ্ণ মিডিয়ায় নিজেকে অভিষেক ব্যানার্জীর অফিসের কর্মচারী হিসেবে পরিচয় করিয়ে দেন। বলেন, ‘‘আমি সেই ২০০৯ সাল থেকে সাহেবের অফিসে কাজ করছি। আমার সাহেব কারও ফোন ধরেন না, কারও সঙ্গে দেখা করেন না। কারও ক্ষমতা নেই আমার সাহেবকে ধরে। সব তদন্ত তাই আমার কাছেই থেমে যাচ্ছে।’’ তাঁর সাহেব কে, তারও উত্তর দিয়েছিলেন সুজয়কৃষ্ণ ভদ্র। বলেছিলেন, সাহেবের নাম অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়।
কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের অফিসের একজন সাধারণ কর্মী হিসেবে সুজয়কৃষ্ণ ভদ্রর এত সম্পত্তি হল কী করে? তাঁর ভুয়ো অফিস কিংবা ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টেই বা এত কোটি কোটি টাকার লেনদেন হল কী করে? কোথায় পেলেন তিনি এত টাকা? তিনি নিজেকে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের অফিসের কর্মী হিসেবে দাবি করেছেন। তাহলে কী সুজয়কৃষ্ণ ভদ্রর নামে যে তিন তিনটি কোম্পানি – এগুলো কার?
সন্দেহ নেই এই প্রশ্নগুলির উত্তরের মধ্যেই লুকিয়ে রয়েছে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে সুজয়কৃষ্ণ ভদ্রর আসল সম্পর্ক। অর্থাৎ এই মুহূর্তে বলতে গেলে সুজয়কৃষ্ণ ভদ্র হলেন সেই চাবি, যা দিয়ে কালীঘাটের মাথার কাছে পৌঁছনো যায়। অন্তত বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারীর বক্তব্য তেমনটাই। আর সেটা যদি সত্যি হয় তাহলে বলতে দ্বিধা নেই, তৃণমূলীদের আশঙ্কাই সত্যি হবে। মানে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়কে ডেকে পাঠাবে ইডি কিংবা সিবিআই।