কলকাতা: মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় (Mamata Banerjee) পুরী গেলেন। তবে যাওয়ার আগে এটাও বললেন, কেন্দ্রের বঞ্চনার প্রতিবাদে ২৯ ও ৩০ তারিখ তিনি আম্বেদকর মূর্তির সামনে ধর্নায় বসবেন।
যতদিন দিন যাচ্ছে, দুর্নীতির জাল ততই লম্বা হচ্ছে। তৃণমূলের ডাল-পালা, শাখা-প্রশাখা ছাড়িয়ে এখন পাতায় পাতায় তল্লাশি চলছে। তদন্তকারীরা কপাকপ একেক জনকে তুলছে, আর তারপরই পরের ছিপটা কোথায় ফেলতে হবে বুঝে যাচ্ছে। ছিপ ফেলে বসার আগেই ফের ফাতনা নড়ে উঠছে। তারপরই ফের তদন্তকারীদের হ্যাঁচকা টানে আরেকজন উঠে পড়ছে। এই মুহূর্তে পশ্চিমবঙ্গে নিয়োগ দুর্নীতি থেকে শুরু করে গরুপাচার, কয়লাপাচারের যে মোট ২৬টি মামলা – আপাতত তার সারমর্ম বলতে গেলে এটুকুই।
কিন্তু তদন্তের রেশ কোথায় গিয়ে পৌঁছবে, আর কার কার টিকিতে টান পড়বে, টিকির সঙ্গে মাথাও আসবে কি না, তার উত্তর কিন্তু এখনও পরিস্কার নয়। এই পরিস্থিতিতে খোদ তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘রাজধর্মে’র কথা মনে পড়েছে। তিনি ফের দিল্লি যাবেন বলে ঠিক করেছেন। তবে এবার সোজা পথে দিল্লি না গিয়ে বরং বাঁকা পথকে বেছে নিয়েছেন।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ধর্না
মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় (Mamata Banerjee) দিন কয়েক আগেও উত্তরবঙ্গে জনসভা করতে গিয়ে দাবি করেছিলেন, কেন্দ্রের কাছে টাকা ভিক্ষা তিনি আর করবেন না। বাঁশের চেয়ে কঞ্চি দড়। অভিষেক ব্যানার্জী আবার তাঁর ডায়মণ্ডহার কেন্দ্রের এক জনসভায় দু’দিন আগে মোদী সরকারকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে জানিয়েছিলেন, কেন্দ্রের টাকা না নিয়েও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বাংলায় দেখিয়ে দেবেন উন্নয়ন কাকে বলে। কিন্তু এসবই যে পাবলিককে খাওয়ানোর খেলা, সেটা প্রমাণ হয়ে গেল মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ফের দিল্লি সফরের সিদ্ধান্তে।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় (Mamata Banerjee) এদিন নিজেই জানিয়েছেন, ২৯ তারিখ বেলা ১২টায় কেন্দ্রের টাকার জন্য ধর্নায় বসবেন। একজন মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে তিনি এই ধর্নায় বসবেন – একথা আলাদা করে মিডিয়ায় উল্লেখ করেছেন মমতা। একই সঙ্গে জানিয়েছেন, তারপর কী হয় তার ভিত্তিতে আগামীদিনে জেলায় জেলায় ব্লকে ব্লকে তৃণমূল কর্মসূচী পালন করবে।
কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের এমন ধর্নায় কি কেন্দ্রের নরেন্দ্র মোদী সরকার টাকা দেবে? কেন্দ্রীয় প্রকল্পে যেভাবে টাকা নয়ছয়ের অভিযোগ পাওয়া গিয়েছে, যেভাবে এদিককার টাকা ওদিক, ওদিককার টাকা এদিক হয়েছে তার জবাব কে দেবে? এরইমধ্যে কেন্দ্রীয় প্রকল্পের টাকা পেতে রাজ্যকে বেশকিছু শর্ত দিয়েছে কেন্দ্র। তারমধ্যে অন্যতম হল, এই টাকা নয়ছয়ে যে বা যাঁরা অভিযুক্ত – তাঁদের বিরুদ্ধে কড়া আইনি পদক্ষেপ করতে হবে।
কিন্তু রাজ্য সরকারের তরফে এখনও পর্যন্ত ১০০ দিনের টাকা নয়ছয় করায় হোক কিংবা প্রধানমন্ত্রী আবাস কিংবা সড়ক যোজনা – কোনও প্রকল্পেই কারও বিরুদ্ধে কোনও আইনি পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। হ্যাঁ, কয়েকটি জেলার জনা কয়েক প্রধান ও পঞ্চায়েত সদস্যকে অবশ্য অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর জনসভার আগে পদ থেকে সরিয়ে দিয়েছেন বটে, কিন্তু আইনি পদক্ষেপ তাঁদের বিরুদ্ধেও হয়নি। এই পরিস্থিতিতে কেন্দ্র মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ধর্নার ভয়ে টাকা দেবে কি?
শুভেন্দু অধিকারীর (Subhendu Adhikari) বক্তব্য
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের এবারের দিল্লি সফর নিয়ে ঘুরে-ফিরে একই কথা বলেছেন রাজ্যের বিরোধীদলনেতা শুভেন্দু অধিকারী। তিনি আরও একবার মিডিয়ায় মুখ্যমন্ত্রীর এই দিল্লি সফর নিয়ে মন্তব্য করতে গিয়ে বলেছেন, ‘‘উনি আসলে ঘুরতে যাচ্ছেন। চারিদিকে শুধু চুরি আর চুরি। অয়ন শীলের বাড়ি থেকে যা মালপত্র পাওয়া গিয়েছে তাতে মুখ্যমন্ত্রীর পালিয়ে যাওয়া আর কোনও উপায় নেই।’’
একই সঙ্গে শুভেন্দুর আরও দাবি, ‘‘ধর্না দিয়ে কোনও মূল্য নেই। এর কোনও গুরুত্ব নেই। চুরির হাত থেকে চোরেদের বাঁচাতেই এসব প্রেসার পলিটিক্স করছে। কেন্দ্র কোনও দিন পশ্চিমবঙ্গকে বঞ্চনা করে নি। গ্রামের লোকেদের জিজ্ঞাসা করে দেখুন, কে কোনও প্রকল্পের টাকা পেয়েছে। কেউ কোনও টাকা পায় নি। শুধু চুরি হয়েছে।’’
মুখ্যমন্ত্রী মমতার (Mamata Banerjee) বক্তব্য
যদিও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় জানিয়েছেন, কেন্দ্রের কাছে পশ্চিমবঙ্গের না কি ১ লাখ ১৫ হাজার কোটি টাকা বকেয়া রয়েছে। কোন খাতে রাজ্যের কোন পাওনা কেন্দ্রের কাছে রয়েছে? মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এদিন তাঁর বক্তব্যে শুধু এটুকুই বলেছেন, ‘‘এবারের বাজেটেও ১০০ দিনের কাজে বাংলাকে একটা পয়সাও দেয়নি। একমাত্র রাজ্য বাংলা, যাকে কিছুই দেওয়া হয়নি। আবাসনেও এক পয়সা দেয়নি। আগের টাকাও দেয় নি। ৫৫ লক্ষ বাড়ির টাকা পড়ে রয়েছে। ১১ লক্ষ আমরা করে দিয়েছি। রাস্তার টাকাও এখনও ছাড়েনি। ১২ হাজার যে আমরা নতুন রাস্তা কিংবা গ্রামের রাস্তা সারাই করছি, সেগুলো আমরা নিজের টাকা দিয়েই করছি।’’
মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এদিন অনেকটা ক্ষোভের সুরেই বলেন, ‘‘আমি নিজে ১০০ দিনের কাজের ব্যাপারে, রাস্তার ব্যাপারে, আবাসনের ব্যাপারে, আমরা কেন্দ্র সরকারের কাছে যে ১ লক্ষ ১৫ হাজার কোটি টাকার মতো পাই বিভিন্ন খাতে, আমি নিজে ৬ মাস আগে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করে এসেছি, অমিত শাহ এখানে মিটিং করতে এসেছিলেন, তাঁকেও বলেছি, তাঁদের সবাইকে বারবার চিঠি লেখা হয়েছে, বারবার বলা হয়েছে, কিন্তু তা সত্ত্বেও দেখতে পাচ্ছি, ডেলিবারেট অ্যাটেম্ট, কিছু টিম পাঠিয়ে দিচ্ছে বিজেপির কথায়, এবং বিজেপির কথায় কোনও কিছু না থাকলেও সিবিআই থেকে ইডি এজেন্সি, যেন মনে হচ্ছে সিবিআই ডিরেক্টর এখন বিজেপির লোকাল প্রেসিডেন্ট বা লোকার রয়েছে যারা, আর ইডিরও প্রেসিডেন্ট হয়ে গেছে ওরা।’’
ধর্নার আগে ওড়িশায় কেন মমতা
মঙ্গলবার ওড়িশায় গেছেন মমতা। জানা গিয়েছে, তিনি পুরীর জগন্নাথ মন্দির দর্শনের পাশাপাশি সে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী নবীন পট্টনায়কের সঙ্গে কথা বলবেন। আর এখানেই প্রশ্ন, বাংলার বঞ্চনার অভিযোগের কথা বলে ওড়িশা কেন? আসলে মোদীর বিরুদ্ধে বিরোধীজোটে নবীনের কি মনোভাব সেটাই জানতে মমতার এই সফর বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।
তাঁদের মতে, কংগ্রেস এড়িয়ে মোদী বিরোধী জোটের চেষ্টায় রয়েছেন তৃণমূল নেত্রী। দু’দিন আগে উত্তর প্রদেশের সমাজবাদী পার্টির নেতা অখিলেশ যাদব কলকাতায় এসে ‘দিদি’র সঙ্গে দেখা করে গিয়েছেন। এতে অখিলেশ যেমন মমতার মন বোঝার চেষ্টা করেছেন, তেমনই মমতাও অখিলেশের খেলা বোঝার চেষ্টা করেছেন। কংগ্রেসের সঙ্গে জোট করেও যখন উত্তর প্রদেশে যোগীর বিরুদ্ধে কিছু করা যায় নি, তখন অখিলেশ ভালোমতই বুঝেছেন রাহুল গান্ধীর ওপর ভরসা না করাই ভাল। এই পরিস্থিতিতে তিনি এখন পুরোপুরিভাবে ‘দিদি’র দিকে।
কিন্তু শুধু অখিলেশকে সঙ্গে নিয়ে তো আর মোদী কিংবা কংগ্রেসের বিরুদ্ধে লড়াই করা যায় না! সুতরাং অন্যদেরও মতি-গতি বোঝা দরকার। তাছাড়া, আরেক ‘দিদি ভক্ত’ লালু যাদবের ছেলে আরজেডি নেতা তেজস্বী যাদব এখন ‘কাকা’ নীতিশের জোটে ভিড়েছে। জেডিইউ প্রধান নীতিশ কুমার আবার নিজেকেই ২০২৪’এ মোদীর বিরুদ্ধে তুলে ধরতে চাইছেন।
ফলে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, এই মুহূর্তে অখিলেশ ছাড়া মমতার সম্ভাব্য জোট ফাঁকা। তেলেঙ্গানার কে চন্দ্রশেখর রাও মোদী বিরোধী বটে, কিন্তু তাঁর ক্ষমতা সীমিত। এই পরিস্থিতি নবীন পট্টনায়কের মতো কিছু মধ্যপন্থী নেতাদের সম্ভাব্য জোটে টানার চেষ্টা করতে চাইছেন মমতা। সেই সঙ্গে মুখ্যমন্ত্রীত্বের কিছু সুখ দুখের কথাও বলা যাবে।
তবে বিরোধীদের মতে, আসলে পুরীর জগন্নাথ মন্দিরে মাথা ঠেকিয়ে ওড়িশার সমুদ্রের হাওয়াটাও মাথায় লাগাতে চাইছেন মমতা। এই মুহূর্তে রাজ্যে দুর্নীতি ছাড়া খবর নেই। তৃণমূল নেতা ছাড়া কোনও গ্রেফতারি নেই। সুতরাং বড় চাপ হয়ে যাচ্ছে।
বিজেপি নেতাদের আরও কটাক্ষ, হাজার হোক পুরী যেতে তো আর নিজের পকেটের পয়সা তো আর লাগছে না। তাছাড়া, প্রাইভেট জেটটা ভাড়া করে দমদমে বসিয়ে রেখেই বা লাভ কি! কত আশা ছিল – ত্রিপুরায় তৃণমূল কিং মেকার হবে, মেঘালয়ে সরকার গড়বে। প্রাইভেট জেটে দু’চারদিন পর পর ত্রিপুরা, মেঘালয়, উত্তরবঙ্গ ঘুরবেন। কিন্তু সে গুড়ে বালি। এতএব পুরী ‘ঘুরতে’ যেতে অসুবিধে কি?