HomeবৈঠকWest Bengal: মমতার ‘প্রিয়’ বিদ্বজনদের মাতৃভাষা নিয়ে মাতামাতির পিছনেও সেই রাজনীতি!

West Bengal: মমতার ‘প্রিয়’ বিদ্বজনদের মাতৃভাষা নিয়ে মাতামাতির পিছনেও সেই রাজনীতি!

- Advertisement -

অরণ্য রায়

বাঙালি ‘বিশিষ্টজনদের’ ’দৈনতা’ আরও একবার প্রকাশ্যে চলে এল। কে ক্ষমতার কাছাকাছি থাকবে, কে মুখ্যমন্ত্রীকে ‘তেল’ গিয়ে শাসকদলের ‘ঘণিষ্ঠ’ হয়ে ‘মাখনটুকু’ খাচ্ছে – সে নিয়ে শুরু হয়ে গেল বাগযুগ্ধ। শাসকদল তৃণমূলের সেই ‘প্রাক্তন ও বর্তমান ঘণিষ্ঠ’দের বাগযুদ্ধে ভাষাদিবসের পরের দিনেও কলকাতা ভাষার লড়াই নিয়ে লড়াই জারি রাখল। আর লড়াইয়ের একদিকে রইলেন শাসকদল তৃণমূলের এককালের ‘ঘণিষ্ঠ বুদ্ধিজীবী’ শুভাপ্রসন। এবং অন্যদিকে রইলেন শাসকদলের ‘বর্তমান ঘণিষ্ঠ বুদ্ধিজীবী’ কবি সুবোধ সরকার এবং বিশিষ্ট প্রবান্ধিক নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ি। এবং মাঝখান থেকে এই বুদ্ধিজীবীদের লড়াইয়ে যিনি ‘আসল বুদ্ধিজীবী’র ভূমিকাটি পালন করলেন – তিনি হলে স্বয়ং পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁর কবিতা নিয়ে নিন্দুকরা কৌতুক করতেই পারেন, কিন্তু ইদানিং তিনিও যে বাংলার প্রথম সারির বুদ্ধিজীবীদের থেকে কোনও অংশে কম যান না – সেটা প্রায় বুঝিয়েই দিলেন।

ঘটনার সূত্রপাত করেছিলেন তৃণমূলের এক কালের ঘণিষ্ঠ শিল্পী শুভাপ্রসন্ন। মঙ্গলবার আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের অনুষ্ঠান মঞ্চে ভাষণ দিতে গিয়ে শুভাপ্রসন্ন বলেছিলেন, ‘‘বাংলা ভাষার উচ্চারণ, বাংলা ভাষার তাৎপর্য, বাংলার ভাষার বৈশিষ্ট্য থেকে আমরা সরে আসছি। আমরা দেখছি বহু কারণে, নানান সাম্প্রদায়িক ছাপ বাংলা ভাষায় চলে এসেছে।’’ এই প্রসঙ্গে তিনি ‘পানি’, ‘দাওয়াত’ শব্দের অনুপ্রবেশ নিয়ে সরাসরি আপত্তি তোলেন। এখানে খেয়াল করার বিষয় হল, শুভাপ্রসন্ন এদিন যে ‘সাম্প্রদায়িকতা’কে খোঁচা দিতে চেয়েছেন – তাতে বিজেপির বদলে তৃণমূলকে বেশি করে বিঁধেছে। কেননা, বাংলা ভাষায় ‘পানি’ আর ‘দাওয়াত’এর অনুপ্রবেশ নিয়ে বিজেপির কোনও মাথাব্যথা নেই। কিন্তু যাঁরা তাঁদের ভাষায় এই দু‘টি শব্দ প্রয়োগ করে থাকেন, তাঁদের পশ্চিমবঙ্গে ‘অনুপ্রবেশ’ নিয়ে শুভেন্দু অধিকারী, দিলীপ ঘোষ কিংবা সুকান্ত মজুমদাররা লাগাতার গলা ফাটাচ্ছেন। যার পিছনে খোদ অমিত শাহর মতো নেতার ‘উস্কানি’ রয়েছে বলে তৃণমূলের নেতারা দাবি করেন। সোজা কথায়, শুভাপ্রসন্নর বক্তব্যের মধ্যে একটা ‘বিজেপি ঘেঁষা’ ব্যাপার লক্ষ্য করেছিল তৃণমূল।

এবং যথারীতি তার জবাবও এল। বিশিষ্ট প্রাবন্ধিক নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ি মহাশয় শুভাপ্রসন্নর এমন মন্তব্যর বিরোধিতা করলেন। কিন্তু ব্যাপারটা এখানেই মিটে গেলে এতটা জলঘোলা হতো না। কিন্তু দুই বুদ্ধিজীবীর লড়াইয়ে ঘোলা জলে মাছ ধরতে আসরে নেমে পড়লেন স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। কেননা, পশ্চিমবঙ্গের অনেকের কাছে এখন না কি তিনিই বাংলার সবথেকে ‘বড় বুদ্ধিজীবী’। এবং সেই মাতৃভাষা দিবসেই ‘দিদি’ শুভাপ্রসন্নকে জবাবে বললেন, ‘‘আমি নৃসিংহ’দার সঙ্গে একমত। কথায় যত বেশি বাংলা শব্দ বৃদ্ধি পাবে, তত বেশি বাংলা ভাষার বৃদ্ধি হবে। আমরা যদি হৃদয়টাকে ছোট করে রাখি, তা হলে হৃদয় কোনও দিনই বৃদ্ধি পাবে না। যত বেশি দেওয়া-নেওয়া হবে, মূল ঐতিহ্যটাকে ঠিক রেখেই আমি ভাষাটাকে বাড়াব। জল বা ওয়াটারকে কেউ কেউ পানি বলে। এটা আপনাকে মেনে নিতে হবে। মাকে কেউ আম্মা বলে। এটাকে মেনে নিতে হবে।’’ মুখ্যমন্ত্রীর এমন মন্তব্যের সমালোচনা হয় না। এপার ও ওপার বাংলার বাংলা যদি এক হয়ে বাঙালির বাংলা হয়ে ওঠে – এর থেকে ভালো কিছু হতে পারে না। কিন্তু একটু রাজনৈতিকভাবে তলিয়ে দেখলেই এই কথার অন্যমানেও বেরিয়ে আসে। বাইরে থেকে অতি সাধারণ একটা মন্তব্যের পিছনে ‘রাজনৈতিক স্বার্থ’রও অনেকে গন্ধ পাবেন। তা না হলে একজন রাজনীতির কারবারির কী প্রয়োজন ছিল ভাষার কারবারিদের তর্কযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার।

আর ঠিক এখানেই শুভাপ্রসন্ন নিজের জেদ ধরে বসলেন। বাংলা সংবাদ মাধ্যমকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের এমন মন্তব্যের জবাব দিতে গিয়ে একেবারে হাটে হাঁড়ি ভেঙে দিলেন। শুভাপ্রসন্ন এবার বললেন, ‘‘নৃসিংহ-ফৃসিংহ কিছু আছে না, তেলবাজ, যাদের জীবনে কখনও আগে দেখিনি আন্দোলন বা অমুক-তমুকে। পরিবর্তনের সরকারের আগে আমরা এত কিছু করেছি! এই লোকগুলো ছিল কোথায়? আজকের সুবোধই বা ছিল কোথায়? ওরা তো উল্টে আমাদের গালাগাল দিত! সেই এরা এখন সবচেয়ে বড় তেলবাজ হয়ে গিয়েছে। আমরা ভাষা বুঝি না, এই সব বড় বড় কথা বলেছে!’’

এখন হাঁটে হাড়ি যখন ভেঙেছে, জবাব তো দিতে হবে। তা নৃসিংহপ্রসাদ মহাশয় দিলেন। তিনি বললেন,‘‘সত্যিই তো ওঁকে আমি শ্রদ্ধা করি। উনি নন্দীগ্রাম আন্দোলন থেকে শুরু করে এখনও পর্যন্ত বিভিন্ন জায়গায় সত্যিই মমতার সঙ্গে খুব জড়িয়ে আছেন।’’ এই কটি লাইনে শুভাপ্রসন্ন সম্পর্কে যা বুঝিয়ে দেওয়ার বুঝিয়ে দিলেন নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ি মহাশয়। এবার পালা কবি সুবোধ সরকারের। তিনি আর বলবেন কি! এরইমধ্যে বাংলা সাহিত্য-সংস্কৃতির জগতে তাঁর একটা স্ট্যাম্প জুটে গেছে। তিনি না কি ‘তৃণমূলি কবি।’ অতএব লুকোনোর জায়গা নেই। তাই তিনি অনেকটা আত্মসমর্পণের মতো করেই জানালেন, ‘‘মঙ্গলবার আমি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা ‘রাস্তার ধুলো’ কবিতাটা ওই অনুষ্ঠানে পাঠ করেছি। কবিতাটা সত্যিই খুব ভাল। সেটা যদি তেল মারা হয়ে থাকে, তবে আমার কিছু বলার নেই। তবে চিরকাল কবিতা পাঠ করে এসেছি। যে যা-ই বলুক, সেটা আমি চালিয়ে যাব। সে যাঁরই কবিতা হোক! কেউ ‘তেলবাজ’ বললেও কবিতাপাঠ বন্ধ করতে পারব না।’’

বলতে দ্বিধা নেই, এমন বিদ্বজনদের মাঝে আমার ফিচলেমি মানায় না। সমালোচনা করা তো দূরের কথা। কিন্তু বাংলা ভাষায় শব্দ ব্যবহারে বিতর্কটুকু ছাড়া যদি পুরো ঘটনাটার মুখোস খুলে ফেলা যায় – তাহলে কিন্তু স্পষ্ট দেখা যাবে, এ হল গিয়ে আম পাবলিকের সাবজেক্ট নিয়ে খেলা। শুভাপ্রসন্নকে ২০১১ সাল বা তার আগে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ডাইনে-বাঁয়ে, সামনে-পিছনে অনেক জায়গাতেই দেখা যেত। কিন্তু ইদানিং সেই জায়গায় নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ির মতো বিশিষ্টজনদের দেখা যাচ্ছে। শুভাপ্রসন্নর কদর যে একেবারেই নেই – একথা বললে ভুল হবে। কিন্তু নতুন যাঁরা দলে ভিড়েছেন তাঁদের শাসকদল একটু বাড়তিই গুরুত্ব দিচ্ছে। আর তাতে শুভাপ্রসন্নর মতো শিল্পীর গোঁসা হওয়ারই কথা। হয়তো সেই গোঁসাটাই তাঁর মুখ দিয়ে বিরেয়ে এসেছে। অন্যদিকে, নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ির মতো বিদ্বজনদের যে মানুষেরা ‘নিরপেক্ষ’ জ্ঞাণের সাধক বলে মনে করতেন – ইদানিং সরকারি আমন্ত্রণে মুখ্যমন্ত্রীর নানা অনুষ্ঠানে গিয়ে চাঁদের হাট লাগানোতে অনেকের মনে প্রশ্ন উঠছে। আর ‘সুবোধ বালকে’র সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে হলে দিন কয়েক বাঙালি শিল্প-সংস্কৃতি জগতের খবর নিলেই হবে।

এই পরিস্থিতিতে বাঙালি বিদ্বসমাজে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে ধীরে ধীরে জায়গা করে দিতেই এ ধরণের তর্জা লড়াই করা হচ্ছে কি না সে নিয়েও প্রশ্ন উঠছে। কেননা, পানি এবং দাওয়াত এই শব্দ দুটোর বাংলায় ব্যবহার নিয়ে এর আগে সাধারণ বাঙালি পাঠকদের মধ্যে যেমন কোনও আপত্তি দেখা যায় নি, ঠিক তেমনই যা এরইমধ্যে ওপারের বাঙালিদের ভাষা, সাহিত্য এমনকী দৈনন্দিন জীবনের অপরিহার্য শব্দ হয়ে গিয়েছে তাকে কী করে নতুন করে বাংলায় ঠাঁই দেওয়া উচিত – সে নিয়েও কাউকে তর্ক করতে দেখা যায় নি। তাহলে পানি আর দাওয়াত নিয়ে এপারের বিদ্বজনদের এত জ্ঞাণ ফলানো কেন?

(প্রবন্ধের বক্তব্য একান্তই লেখকের নিজস্ব)

- Advertisement -
- Advertisement -
- Advertisement -
- Advertisement -