কলকাতা – আবাস প্রকল্পে ১৫-৩০ ডিসেম্বরের মধ্যে ছাড়া হবে প্রথম কিস্তির বরাদ্দ। এমনই ঘোষণা করল রাজ্যের মমতা সরকার। সেই সঙ্গে লক্ষ্মীর ভান্ডার প্রকল্পে আরও যে প্রায় পাঁচ লক্ষ নতুন মানুষকে যুক্ত করা হয়েছে তাঁদের ডিসেম্বর থেকে টাকা দেওয়া হবে। রাজ্যের নিজস্ব প্রকল্পের পক্ষে সওয়াল করে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ঘোষণা করেছেন, কেন্দ্রের নরেন্দ্র মোদী সরকার যদি অল্প সময়ের জন্য কোনও প্রকল্প চালু করে তাহলে তা পশ্চিমবঙ্গের তৃণমূল সরকার তাতে যুক্ত হবে না।
তবে এখানেই শেষ নয়, বৃহস্পতিবার নবান্নে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় জানিয়েছেন, সব মিলিয়ে মোট চারটি প্রকল্পে উপভোক্তার সংখ্যা বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে রাজ্য সরকার। লক্ষ্মীর ভান্ডার, আবাস ছাড়া সেই তালিকায় রয়েছে বিধবা ভাতা এবং বিশেষ ভাবে সক্ষমদের ভাতা প্রকল্প।
দুর্নীতি এবং বেনিয়মের অভিযোগে আপাতত প্রধানমন্ত্রী আবাস এবং একশো দিনের কাজের প্রকল্পে বরাদ্দ বন্ধ রেখেছে কেন্দ্র। যা নিয়ে গ্রামে-গঞ্জে ক্ষুব্ধ মানুষ। এই পরিস্থিতিতে মানুষকে ‘খুশি‘ করতে রাজ্যের ভান্ডার থেকেই আবাস প্রকল্পের বরাদ্দ দেওয়ার কথা গত লোকসভা ভোটের প্রচারে ঘোষণা করেছিলেন মমতা। সেই মতো শুরু হয়েছিল নতুন নামের তালিকা তৈরির প্রক্রিয়া। যা নিয়েও জেলায় জেলায় দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে। কিন্তু সবকিছু সামলে আপাতত উপভোক্তা তালিকার পুনর্যাচাই প্রক্রিয়া প্রায় শেষ লগ্নে। তাই এবার প্রথম কিস্তির দিন তারিখ ঘোষণা করে দিল রাজ্যের মমতা ব্যানার্জীর সরকার।
মুখ্যমন্ত্রী মমতা জানিয়েছেন, আবাসের মূল তালিকার ১১ লক্ষ উপভোক্তাকে প্রথম কিস্তির বরাদ্দ দেওয়া হবে ১৫-৩০ ডিসেম্বরের মধ্যে। প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের কারণে আরও ১ লক্ষ মানুষকে বাড়ি তৈরির ওই টাকা দেওয়া হবে। সব মিলিয়ে ১২ লক্ষ উপভোক্তা প্রথম কিস্তির টাকা পাবেন। মমতার কথায়, “আমি যা কথা দিই, তা রাখি।”
তিনি আরও জানান, দু’টি কিস্তিতে বরাদ্দ দেওয়া হবে। ফলে ৬০ হাজার টাকা করে মোট ১ লক্ষ ২০ হাজার টাকা করে পাবেন প্রত্যেক উপভোক্তা। মমতার কথায়, “রাজ্য ৪০% টাকা দেয়, তার পরেও প্রধানমন্ত্রীর নামে প্রকল্প কেন? আমি তো আমার নামে কোনও প্রকল্প করিনি। ১০ বছর পরে আমি মারা গেলেও, কেউ আমার মূর্তি তৈরি করুক, তা চাই না।”
এদিন যথারীতি কেন্দ্রের নরেন্দ্র মোদী সরকারকে একহাত নিয়ে মমতা বলেন, “তিন বছর কেন্দ্র আমাদের টাকা দেয়নি। কেন্দ্রের থেকে ২৪ হাজার ২৭৫ কোটি টাকা পাই। এ বার থেকে এই প্রকল্পের নাম ‘বাংলার বাড়ি’। ১২ বছরে ৫০ লক্ষ বাড়ি করে দিয়েছি। টাকা আমাদের, নামও আমাদের।”
আবাস যোজনার তালিকায় নাম তোলা নিয়ে জেলায় জেলায় যে দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে তা সামাল দিতে মমতা জানান, ১২ লক্ষকে বাড়ি তৈরির টাকা দেওয়ার পরে আরও ২৪ লক্ষ উপভোক্তা বাকি থাকবেন। তাঁদেরও দফায় দফায় টাকা দেওয়া হবে। তাঁর কথায়, “এরজন্য দু’তিন বছর সময় নিচ্ছি।”
কথা দিয়েছেন বলে রাজ্যের ভাঁড়ার থেকে আবাস যোজনার টাকা দিচ্ছেন ঠিকই কিন্তু মমতা জানেন, তাঁর আসল ‘হাতিয়ার’ লক্ষ্মীর ভান্ডার। আর তাই লক্ষ্মীর ভান্ডার পাওয়া মহিলাদের সংখ্যা আরও বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে রাজ্যের তৃণমূল সরকার। মুখ্যমন্ত্রীর দাবি, লক্ষ্মীর ভান্ডারে আরও ৫ লক্ষ ৭ হাজার উপভোক্তাকে নতুন করে যুক্ত করা হয়েছে। যাঁরা আজীবন ভাতা পাবেন। এখন ওই প্রকল্পে উপভোক্তার সংখ্যা ২.২১ কোটি। তাতে এতদিন পর্যন্ত সরকারের মোট খরচ হয়েছে ৪৮ হাজার ৪৯০ কোটি টাকা। নতুন ৫.০৭ লক্ষের জন্য অতিরিক্ত আরও প্রায় ৬২৫ কোটি টাকা খরচ হবে।
লক্ষ্মীর ভান্ডার প্রকল্প যে একান্তই তাঁর সরকারের ‘জিনিস’ সেকথা বলতে গিয়ে মমতা বলেন, “ভোটের কথা মাথায় রেখে অন্যান্য রাজ্যও মহিলাদের টাকা দেওয়ার কথা বলছে। কিন্তু তা পেতে গেলে প্রচুর শর্ত পূরণ করতে হয়। আমাদের রাজ্যে কোনও শর্ত নেই। প্রত্যেকের জন্য প্রকল্প উন্মুক্ত। এমনকি, পরিবারে চারজন মহিলা থাকলেও প্রত্যেকে টাকা পাবেন।”
পাশাপাশি যাঁরা লক্ষ্মীর ভান্ডার থেকে বঞ্চিত তাঁদেরও খুশি করতে আরও ৪৩ হাজার ৯০০ জনকে বিধবা ভাতা দেওয়ার কথা বলেছেন মুখ্যমন্ত্রী। তারও প্রথম কিস্তির টাকা ডিসেম্বর থেকে চালু হবে জানিয়েছেন তিনি। এখন তাতে উপভোক্তা সংখ্যা ছিল ২০ লক্ষ ৩২ হাজার। তাতে খরচ হত ২৪৫০ কোটি টাকা। নতুন অন্তর্ভুক্তির ফলে খরচ বেড়ে হবে তিন হাজার কোটি টাকা। যদিও বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারীর দাবি, বিধবা ভাতার বেশিরভাগ টাকাটাই কেন্দ্রের নরেন্দ্র মোদী সরকারের টাকা।
পাশাপাশি, বিশেষ ভাবে সক্ষম প্রায় সাড়ে সাত লক্ষ উপভোক্তা ভাতা পেতেন মোট ৯০০ কোটি টাকার। এবার আরও ১৯ হাজার নতুন উপভোক্তাকে তাতে যুক্ত করার কথা জানিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা। এছাড়াও নতুন কৃষকবন্ধু প্রকল্পে প্রায় ১.০৮ কোটি উপভোক্তাকে একটি কিস্তির ২৯৪৩ কোটি টাকা বরাদ্দে ছাড়পত্র দিয়েছে রাজ্য।
যদিও আর্থিক পর্যবেক্ষকদের একাংশের মতে, মমতা সরকারের এমন জনমোহিনী প্রকল্পে খরচ বেড়ে যাওয়ার ফলে পশ্চিমবঙ্গের আর্থিক অবস্থা আরও খারাপ হবে। এমনিতেই রাজ্যের ভাঁড়ে মা ভবানী দশা। তারপরেও লাগাতার তৃণমূল সরকার কোনও আয়ের সীমারেখা না রেখে ঢালাও টাকা দিচ্ছে। এতে রাজ্যের ওপর ধারের বোঝা বাড়ছে। বামপন্থী সরকার ক্ষমতা ছাড়ার সময় পশ্চিমবঙ্গের ঘাড়ে যে ঋণের পরিমাণ ১ লক্ষ ৭০ হাজার কোটির কাছাকাছি ছিল, মমতা সরকারের একের পর এক জনমোহিনী প্রকল্পের ফলে সেটাই বেড়ে এখন ৬ লক্ষ কোটি টাকার কাছাকাছি হয়েছে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের একাংশের দাবি, এতে আপাতত ভাবে রাজ্যের মানুষ খুশি হলেও অদূর ভবিষ্যতে বাংলার আর্থিক দুর্দশা আরও বাড়বে। আর তার মাশুল ঘুরে-ফিরে সাধারণ মানুষকেই ভুগতে হবে। যদিও তৃণমূল নেতাদের যুক্তি, যেহেতু রাজ্যের আয় বেড়েছে ফলে ঋণের পরিমাণ বাড়লেও বোঝা হালকা হয়েছে। ফলে বাংলা কিংবা বাঙালির ভবিষ্যতে কোনও সমস্যা হবে না।