HomeবৈঠকKunal Ghosh: জেলযাত্রার জ্বালা লুকোতেই কি মমতা-অভিষেককে লড়িয়ে দিলেন কুণাল

Kunal Ghosh: জেলযাত্রার জ্বালা লুকোতেই কি মমতা-অভিষেককে লড়িয়ে দিলেন কুণাল

- Advertisement -

অরণ্য রায়

ইদানিং পশ্চিমবঙ্গের শাসকদল তৃণমূল মহাফাঁপড়ে পড়েছে। একটু ভুল হল – বলা ভাল নতুন ফাঁপড়ে পড়েছে। আর সেটা তৈরি করছেন খোদ তৃণমূলের মুখপাত্র তথা রাজ্য সম্পাদক কুণাল ঘোষ (Kunal Ghosh)। ঘটনাটা সামান্যই। এবারের বিশ্ববঙ্গ বাণিজ্য সম্মেলনে মমতার ছবির পাশে কেন অভিষেকের ছবি ছিল না – সেই নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন খোদ তৃণমূলের মুখপাত্র (Kunal Ghosh)। কিন্তু এই প্রশ্ন তৃণমূলের অন্দরের অনেক প্রশ্নকেই নতুন করে উসকে দিয়েছে। সব থেকে বড় প্রশ্ন হল – তৃণমূলে মমতা বনাম অভিষেকের লড়াই কি তাহলে এখনও ধিকি ধিকি জ্বলছে? তৃণমূলের ক্ষমতা আগামীদিনে কার হাতে থাকবে সেনিয়ে দড়ি টানাটানি চলেছে?

এক সময়ে সারদা মামলায় জেলে যাওয়া কুণাল ঘোষ যে এখন তৃণমূলে বেশ রসে-বসে রয়েছেন, এটা নিন্দুকেরাও স্বীকার করবেন। এর পিছনে কুণাল ঘোষের (Kunal Ghosh) যেমন লড়াকু মানসিকতা রয়েছে তেমনই এতে অভিষেকেরও যে হাত রয়েছে। কুণাল ঘোষ এটা অস্বীকার করতে পারেন না। বন্দি থাকা অবস্থায় যেভাবে তিনি মুখ্যমন্ত্রীকে সবকিছুর পিছনে দায়ী করেছিলেন, এবং সারদা কেলেঙ্কারির সবথেকে লাভবান ব্যক্তি বলে তোপ দেগেছিলেন – অভিষেক না থাকলে মমতার মঞ্চে ফের জায়গা পাওয়া কুণালের হতো না। সুতরাং তৃণমূলে কুণাল ঘোষ যে অভিষেক পন্থী হবেন – এটাই স্বাভাবিক। সেই কারণেই কি অভিষেকের ছবি না থাকায় মমতার বিরুদ্ধে বীরত্ব দেখাতে গেলেন কুণাল?

কুণাল ঘোষ কিন্তু সেটা স্বীকার করছেন না। তাঁর কথায়, ‘‘তৃণমূল মানেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় – একথা যেমন ঠিক, তেমনই তৃণমূলের জন্য অভিষেকের পরিশ্রমকে অস্বীকার করা যায় না।’’ সেই কারণেই তাঁর দাবি, মমতার পাশে অভিষেকের ছবি না রাখাটা না কি ঠিক হয়নি। কিন্তু কুণাল ঘোষ এখানেই থামেননি। কথার ওপর কথা জুড়তে গিয়ে তিনি আরও কয়েকটি কথা বলে ফেলেছেন। এবং সেই কথাগুলোও বিতর্কের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কুণাল ঘোষের মতে, তৃণমূলের প্রবীণদের এবার নবীনদের জন্য জায়গা ছেড়ে দেওয়ার সময় হয়েছে। ‘যতদিন দেহ থাকবে ততদিন পদ থাকবে’ এই ছকে চললে হবে না। কুণালের আরও বক্তব্য, রাজ্য সরকার এমন কিছু কাজ করছে যার জেরে তৃণমূলের মুখপাত্রদের কাজ কঠিন হয়ে যাচ্ছে। মানে মিডিয়ায় জবাবদিহি করতে গিয়ে মহা সমস্যায় পড়তে হচ্ছে।

খেয়াল করার মতো বিষয় হল – এই দুটি দাবিতেই কুণাল ঘোষ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার পরিচালনা এবং দল পরিচালনা নিয়ে সওয়াল তুলে দিয়েছেন। কেননা, দুটো ক্ষেত্রেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ই শেষকথাটা বলেন। যদিও কুণাল ঘোষ বন্দুকের নলটা অন্যদিকে ঘোরাতে গিয়ে যুক্তি দিয়েছেন, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নয় – তিনি সেই সব নেতাদের কথা বলছেন যাঁরা তৃণমূলে হিল্লি-দিল্লি করতে গিয়ে হাঁপিয়ে পড়ছেন। এবং মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকারকে ভুল পরামর্শ দিচ্ছেন। কিন্তু কুণাল ঘোষ এটা ভুলে গিলেন, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও আর ইদানিং আগের মতো ছোটাছুটি করতে পারছেন না। একটু এদিক-ওদিক হলেই তাঁর পা মচকে যাচ্ছে। তাহলে কি ঘুরিয়ে কুণাল ঘোষ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের জন্য জায়গা ছেড়ে দেওয়ার কথা বলছেন?

কাকতালীয় ভাবে কুণাল ঘোষ এমন সময়ে এই বিতর্ক তৈরি করলেন যখন অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় নিজেকে ঘরবন্দি করে রেখেছেন। দুবাই ও ইতালি সফরের পর যখন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় পায়ের ব্যথা নিয়ে কালীঘাটে বসেছিলেন সেই সময়ে কিন্তু অভিষেক দিল্লিতে গিয়ে ১০০ দিনের বকেয়া টাকার জন্য লড়াই করছিল। সেখানে কিছু না হওয়ার পর বাংলায় ফিরে এসে ঘরে বসে না থেকে রাজ্ভবনের সামনে অনির্দিষ্ট কালের জন্য ধর্নাতেও বসেছিলেন। সেই ধর্না তিনি তুললেন যখন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বললেন। এরপরই মমতা কালীঘাট থেকে বেরিয়ে নিজের হাতে বিজেপি কিংবা কেন্দ্রের নরেন্দ্র মোদী সরকারের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের সব ব্যাটন তুলে নিলেন। আর অভিষেককে দেখা গেল তিনি একেবারে চুপ করে গেলেন। এমনকী বিশ্ববঙ্গ বাণিজ্য সম্মেলনেও গরহাজির থাকলেন। তৃণমূল বিতর্ক এড়াতে আগেই জানিয়ে দিল – অভিষেকের চোখ ভালো নেই। তাই এই গরহাজিরা। কিন্তু মুখপাত্র কুণাল ঘোষ আগ বাড়িয়ে এমন মন্তব্য করলেন যাতে তৃণমূলের শাক দিয়ে মাছ ঢাকা আর হল না।

কুণাল ঘোষ হতে পারে অভিষেকের মনের কথায় তাঁর বিতর্কিত মন্তব্যে তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন। যে কথাটা অভিষেক সরাসরি মমতাকে বলতে পারবেন না। কিন্তু অভিষেক তৃণমূলকে গত ৫-৬ বছর ধরে নিজের মতো করে তৈরি করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। প্রশান্ত কিশোরের কাছে রাজনীতির রণকৌশলের পাঠ নিয়ে আইপ্যাককে সঙ্গে নিয়ে নিজেই ডায়মন্ড হারবার মডেল বানিয়েছেন। আর সেই ডায়মন্ড হারবার মডেলকে আরও একধাপ জনপ্রিয় করতে কেন্দ্রের বন্ধ থাকা বার্ধক্যভাতার টাকা তৃণমূলের ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়েছেন। ঘোষণা করেছেন, প্রত্যেক জেলার তৃণমূল নেতারাই সেই টাকা জোগাড় করে সাধারণ মানুষকে দেবেন। আর এর শুরুটা হবে তাঁর সংসদীয় এলাকা ডায়মন্ড হারবার থেকেই।

অভিষেকের এমন ফর্মুলায় ডায়মন্ড হারবারের মানুষ নিশ্চয় খুশি হয়েছেন। কিন্তু তৃণমূলের নেতা-মন্ত্রীরা খুশি হতে পারেন নি। কেননা, এমনিতেই ইডি-সিবিআইয়ের দাপাদাপি রোজগারপাতির খারাপ অবস্থা। এরপর যদি বার্ধক্যভাতার কয়েক কোটি টাকা জোগার করতে হয় তাহলে নিজেদেরই ভাঁড়ারে টান পড়বে। রাজ্য সরকারের ভাঁড়ারে টান না হয় দিদির কথায় মেনে নিয়েছেন, কিন্তু নিজের পকেট থেকে পয়সা বের করে জনসেবা করতে হবে – এটা মানা যাবে না। দলের নেতা-মন্ত্রীদের এমন মনোভাব দলনেত্রীর বুঝতে অসুবিধে হয়নি। বুঝতে এটাও অসুবিধে হয়নি অভিষেককে আরও ‘ছাড়’ দিলে পুরনো তৃণমূলীদের মধ্যে বিক্ষোভ বাড়বে। দল ছাড়ার হিড়িক তৈরি হবে। সামনেই লোকসভা ভোট। এমনিতেই দুর্নীতির দায়ে সবাই চোর সেজে বসে আছে। তারপর যদি দল ছাড়ার হিড়িক শুরু হয় – সময়ের আগেই তৃণমূলের সরকার পড়ে যাবে। অভিষেকের ডায়মন্ড হারবার মডেলের ঠ্যালায় সেই রকমই সম্ভাবনা তৈরি হচ্ছে। অতএব লাগামে টান দিতে দেরি করেন নি দলনেত্রী। সেটাই কি কুণাল ঘোষ মেনে নিতে পারছেন না?

কুণাল ঘোষ নিজেকে তৃণমূলের বিবেক তুলে ধরতে চাইছেন। বলছেন, তিনি যা বলছেন মমতা-অভিষেকের স্বার্থে, দলের ভালোর জন্য বলছেন। তিনি নিজে মন্ত্রী কিংবা বিধায়ক হতে চান না। দলের সংগঠনের জন্য সৈনিক হিসেবে কাজ করে যাবেন। তবে এসব কথা বলার জন্য দলনেত্রী যদি তাড়ায় – তাড়াবে। এতে তাঁর কোনও আপত্তি নেই। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, যে তৃণমূল নেত্রী ১০ বছর আগে তাঁকে সারদা মামলায় জেলে পুরেছিল বলে কুণাল ঘোষ নিজেই দাবি করেন, সেই দল কিংবা দলনেত্রীকে নিয়ে তাঁর এত দরদ কেন?

আসলে এত কথা বলার কুণাল ঘোষের প্রয়োজন হত না, যদি না তিনি এসব বিতর্কের আগে সোশাল মিডিয়ার সেই পোস্টটা করতেন। যে পোস্টে তিনি তাঁর জেলযাত্রার ১০ বছর পূর্তি উপলক্ষে নিজের অপমানের জ্বালা ব্যক্ত করতে গিয়ে লিখেছিলেন ‘‘আজও ভুলিনি সেদিনের কথা।’’ তৃণমূলে নতুন করে ইনিংস শুরু করে গত ৬ বছরেই নাম্বার ৩। উপরে শুধু মমতা আর অভিষেক। এরপরেও কুণাল ঘোষ জেলযাত্রার যন্ত্রণা, অপমান ভোলেন নি। এই কথা সোশাল মিডিয়ায় লিখে কুণাল ঘোষ কী বোঝাতে চাইলেন? এই প্রশ্নটা বাংলা সংবাদ মাধ্যমে উঠতে না উঠতেই কুণাল ঘোষ অভিষেকের ছবি নিয়ে পড়ে গেলেন। ছবির পাশাপাশি আরও দু’তিনটি বিতর্কিত কথা বলে মিডিয়ায় জল্পনা তৈরি করে দিলেন। এখন সবাই সেই মমতা বনাম অভিষেকের পুরনো কাসুন্দি ঘাটতে ব্যস্ত। কিন্তু এর মাঝে কুণাল ঘোষের জেলযাত্রার জ্বালা জ্বলে উঠেও যে দপ করে নিভে গেল – সেটা আর কেউ খেয়াল করলেন না। তাহলে কি নিজের জেলযাত্রার অপমানের ধিকি ধিকি আগুন আরও একবার নিজের বুকের এক কোনে লুকিয়ে ফেলতেই কুণাল ঘোষের এত জলঘোলা করা? প্রশ্নটা কিন্তু অনেক তৃণমূলের নেতারাও তুলছেন।

(লেখকের বক্তব্য একান্তই তাঁর নিজস্ব)

- Advertisement -
- Advertisement -
- Advertisement -
- Advertisement -