ঢাকা – ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি’। আজই তো সেই দিন, নিজের ভাষার জন্য রক্তে ভেসে গিয়েছিল ঢাকা শহর থেকে শুরু করে ওপার বাংলার কত গ্রাম শহরতলি। এই একুশ সকল বাঙালির আবেগ। আজ ২১ ফেব্রুয়ারি, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস (International Mother Language Day 2023)। এই দিনের ইতিহাসের সঙ্গে জড়িয়ে আছে বাংলাদেশের স্বপ্ন, তার জন্ম এবং অবশ্যই ঐতিহ্যের নানা কথা। কিন্তু সেই ইতিহাসে রয়েছে আত্মত্যাগ, নিরলস সংগ্রাম এবং হার না মানা মনোভাব। সেই সব কিছু মিলিয়েই পালন করা হয় আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস।
মঙ্গলবার সকাল থেকে ঢাকার রাস্তায় মানুষের ঢল নেমেছে। ছাত্রছাত্রীরা প্ল্যাকার্ড হাতে রাস্তায় প্রভাতফেরি করেছেন। মেঘলা আকাশে আবেগ ও গর্বে ভরে উঠেছে পথঘাট। সারা বাংলাদেশের মানুষ ভিড় করেছেন মিনারের পাদদেশে। মাইকে বাজানো হচ্ছে বাংলা গান। সেই গানের সঙ্গে গুনগুন করে শোভাযাত্রায় পা মেলালেন হাজার হাজার মানুষ। শোক পালনের জন্য মানুষ মূলত সাদা-কালো পোশাকে সেজে এদিন পা মেলান শোভাযাত্রায়।
আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের ইতিহাস (International Mother Language Day)
তখনও মৌলানা ভাসানি, বঙ্গবন্ধু মুজিবরের জয়বাংলা ডাকে তেমন করে মাতেনি বাংলাদেশ (Bangladesh)। তখন বাংলাদেশ- পূর্ব পাকিস্তান। তখন ঊনিশশো বাহান্ন। এরপই সোজা ১৯৭১ সাল। শুধুমাত্র বাংলাভাষার জন্য একটি রাষ্ট্র তৈরি হয়। বাংলাদেশ। একটা ভাষা-একটা মন-একটাই পরিচয় বাঙালি। যে মায়ের ভাষার অধিকার রক্ষার লড়াই থেকে একটি রাষ্ট্রের জন্ম। যে লড়াই ভাইয়ের রক্তে রাঙানো অমর ২১। আজ সেই ভাষা দিবস। যে ভাষাকে বাঁচিয়ে রাখার এই যুদ্ধ আজ বাংলাদেশের কাঁটাতার পেরিয়ে আন্তর্জাতিক তকমা পেয়েছে।
বাংলাদেশের বাঙালিদের ভাষার প্রতি ভালোবাসা ও আত্মত্যাগকে সম্মান জানিয়ে ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর অনুষ্ঠিত ইউনেস্কোর প্যারিস অধিবেশনে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের বিষয়টি উত্থাপন করা হয়। ১৮৮টি দেশ এই বিষয়টিকে সমর্থন জানালে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস গৃহীত হয়। ২০১০ সালের ২১ অক্টোবর জাতিসংঘের ৬৫তম অধিবেশনে প্রতি বছর ২১ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালনের প্রস্তাব আনে বাংলাদেশ, যা সর্বসম্মত ভাবে গৃহীত হয়।
মাতৃভাষা দিবস পালনের সঙ্গেই চলে আসে রফিক, সালাম, বরকত ও আব্দুল জব্বারদের নাম। কারা ছিলেন তাঁরা?
১৯৫২ সালের এই দিনেই রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলার দাবিতে আন্দোলনকারী ছাত্রদের উপরে গুলি চালিয়ে দেয় তৎকালীন পাক সরকারের পুলিশ। শহিদ হন সালাম, বরকত, রফিক, জব্বার, শফিউররা। সেদিন পাকিস্তানের পুলিশ গুলি চালালেও প্রতিবাদ থামানো যায়নি। তাই এই দিনটি ভাষা শহীদ দিবস হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে। ওই ঘটনা নাড়িয়ে দিয়েছিল গোটা দুই বাংলাকে। বাংলাদেশের কবি ফজলে লোহানী লিখেছিলেন,শহরে সেদিন মিছিল ছিল।
পৃথিবী সেদিন উল্টো ঘোরেনি, এগিয়ে গেছে।
সবাই শুনলো খুন হয়ে গেছে, খুন হয়ে গেল।
মায়ের দু’চোখের দু’ফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়েছে রমনার পথে।
আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে কবিতা পড়লেন মমতা
এদিন কলকাতার দেশপ্রিয় পার্কে ভাষা স্মৃতিস্তম্ভে শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি বলেন, “বৈচিত্রের মধ্যে ঐক্যর অর্থ যেমন সকলকে এক করা, তেমনই ভাষার বৈচিত্র কিন্তু হৃদয়ের বৈচিত্রেরও অঙ্গীকার। হৃদয়কে সঙ্কীর্ণ করে রাখলে, তার বিস্তার ঘটে না। মূল ঐতিহ্যকে ঠিক রেখে, যত বেশি দেওয়া-নেওয়া হবে, তত বেশি বিস্তার ঘটবে বাংলা ভাষার। কতক গুলি শব্দ আছে বাংলায়। যেমন, কেউ জল বলেন, কেউ বলেন পানি। এটাকে মেনে নিতে হবে।”
২১ ফেব্রুয়ারি নিয়ে নিজের লেখা কবিতাও পড়ে শোনান মমতা। কবিতার নাম ‘একুশে’ বলে জানান তিনি। এর পর মমতা পড়ে চলেন-
একুশে মানেই অঙ্গীকার, একুশে মানে ভাষা
একুশে মানেই পথ চলা, নব প্রজন্মের দিশা
একুশে মানেই মাটির আশীর্বাদ, আজানে প্রাণের সুর
একুশে মানেই গণতন্ত্র, অধিকার সুমধুর
একুশে মানে ভালবাসা, বেঁচে থাকার ভরসা
একুশে মানে সংগ্রামী জীবন, আগামীর নব আশা
একুশে মানে তোমার আমার বেঁচে থাকার অধিকার
একুশে মানে নতুন উদয়, এগিয়ে বাংলা সবার…
পেট্রাপোলে ভাষাদিবস পালন ভারত-বাংলাদেশের
প্রতিবছরের মতো এ বছরও ভারত-বাংলাদেশের পক্ষ থেকে বনগাঁ পেট্রাপোল নোম্যান্সল্যান্ডে পালিত হল আর্ন্তজাতিক মাতৃভাষা দিবস। দু’দেশের প্রতিনিধিরা শহিদ বেদীতে মালা দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় ও বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পাঠানো পুষ্পার্ঘ্য শহিদ বেদিতে নিবেদন করেন দু’দেশের প্রতিনিধিরা। তবে এ বছর ভাষা দিবসে নোম্যান্সল্যান্ডের অনুষ্ঠানে অংশ নিতে পারেননি দু’দেশের সাধারণ নাগরিকরা।