নয়াদিল্লি : ভারতের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ অরুণাচল প্রদেশের বেশ কিছু এলাকার নাম পরিবর্তন নিয়ে এই মুহূর্তে নয়াদিল্লির সঙ্গে বেজিংয়ের (Indo-China) বাগযুদ্ধ বা কথার লড়াই শুরু হয়ে গিয়েছে। এবং এই লড়াইয়ের উস্কানিটা এসেছে যথারীতি চিনের তরফ থেকেই।
দিন কয়েক আগে চিন নতুন করে ভারতের অরুণাচল প্রদেশকে (Arunachal Pradesh) ‘নিজের অংশ’ বলে দাবি করে ১১টি জায়গার নাম পরিবর্তন করে দেয়। পালটা ভারতও জানিয়ে দেয়, চিনের এমন পাগল প্রলাপে’র কোনও মানে নেই। অরুণাচল প্রদেশের প্রত্যেকটি এলাকা ভারতের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ।
এর আগে যতবারই চিন অরুণাচল প্রদেশকে (Arunachal Pradesh) নিয়ে এধরনের উদ্ভট দাবি করেছে, ভারতের পালটা দেওয়ার পরই তা থিতিয়ে গিয়েছে। কিন্তু এবার বেজিং যেন ব্যাপারটাকে নিয়ে একটু বেশি করেই খেলতে চাইছে। ভারতের প্রতিক্রিয়ার পর চিনা বিদেশ মন্ত্রকের মুখপাত্র মাও নিং নতুন করে দাবি করেছেন, অরুণাচল প্রদেশের বিভিন্ন এলাকার নাম পরিবর্তন না কি চিনের সার্বভৌম অধিকার।
আর এখানেই প্রশ্ন উঠছে, চিন নতুন করে ভারতের সঙ্গে পায়ে পা লাগিয়ে ঝগড়া বাধাতে চাইছে কেন? গালওয়ান সংঘর্ষের পর লাদাখ সীমান্ত নিয়ে নয়াদিল্লি এবং বেজিংয়ের মধ্যে বিতর্ক এখনও রয়েছে। কিন্তু তারই মাঝে দেখা যাচ্ছে চিন ভারতের উত্তর-পূর্ব সীমান্তে খোঁচা দিতে শুরু করেছে।
প্রশ্ন হচ্ছে, একদিকে চিনের সঙ্গে ভারতের বাণিজ্যিক সম্পর্ক যখন লাগাতার বেড়েই চলেছে তখন লাল ড্রাগন এভাবে নয়াদিল্লি ও বেজিংয়ের স্পর্শকাতর সম্পর্ককে খুঁচিয়ে ঘা করতে চাইছে কেন?
অরুণাচল প্রদেশ নিয়ে বিতর্ক
পুরোনো ইতিহাসে অরুণাচল তিব্বতের (Tibbets Controversy) অংশ ছিল। ১৯১০ সালে চিনের কুইং রাজবংশের দখলদারির শিকার হয় তিব্বত। ১৯১২-১৩ সালের দিকে কুইং বংশের পতনের সুযোগ নিয়ে তিব্বত স্বাধীনতা ঘোষণা করে। এ সময় থেকে এই অঞ্চলের সীমানা বিতর্ক ও বিরোধের শুরু।
ভারতে তখন ইংরেজরা শাসন করছে। ঔপনিবেশিক শাসকেরা ৮৯০ কিলোমিটার লম্বা ‘ম্যাকমোহন লাইন’কে তিব্বতের সঙ্গে ভারতের সীমানা হিসেবে ঠিক করে। কিন্তু চিন তিব্বতের স্বাধীনতা মেনে নিতে রাজি হয়নি। এদিকে, চিনের প্রতিবাদ সত্ত্বেও তিব্বত ১৯১৪ সালের শিমলা কনভেনশনের মাধ্যমে ‘এটা ’ম্যাকমোহন লাইন’কে আন্তর্জাতিক সীমানা হিসেবে মেনে নেয়।
ম্যাকমোহন লাইনের (Mack Mohan Line) দক্ষিণে রয়েছে অরুণাচল। এই ম্যাকমোহন লাইনের কারণেই অরুণাচলের ভারতভুক্তি ন্যায্যতা পায়। কিন্তু শিমলা কনভেনশনে ম্যাকমোহনের পাথর দিয়ে টানা সীমান্তকে এখনও মানতে রাজি নয় চিন।
কিন্তু ভারত ১৯৩৭ সালে এই ‘ম্যাকমোহন লাইন’-এর ভিত্তিতেই তার আন্তর্জাতিক মানচিত্র তৈরি করে ফেলে। এখন অরুণাচল সম্পূর্ণই ভারতের অংশ। স্বাভাবিকভাবে ভারতের তরফ থেকে অরুণাচল নিয়ে কোনো বিতর্কই পাত্তা দেওয়া হয় না।
ওদিকে আবার চিনও তাদের যে স্কাই ম্যাপ সেখানে অরুণাচল প্রদেশকে নিজেদের বলে দেখাতে শুরু করে। স্কাই ম্যাপ চিনের ডিজিটাল মানচিত্র বানানোর দায়িত্বে রয়েছে। সেই ডিজিটাল মানচিত্রে চিন অরুণাচল প্রদেশের নাম দিয়েছে ‘জাংনান’। যার মধ্যে রয়েছে ৫টি পর্বতশৃঙ্গ। ২টি মালভূমি অঞ্চল, ২টি আবাসিক এলাকা এবং ২টি নদী।
এই জাংনান প্রদেশেরই ১১টি জায়গার নতুন করে নাম পরিবর্তন করে বিতর্ক উসকে দিয়েছে চিন। তবে এবারই প্রথম নয়, এর আগেও এই কাজ করেছে চিন। ২০১৭ সালে দলাই লামার অরুণাচল সফরের পরে সে রাজ্যের ৬টি জায়গার নাম বদল করে চিনা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক। ২০২১ সালে আরও ১৫টি জায়গায় নাম বদলের কথা জানিয়েছিল তারা।
অরুণাচল ও চিনের মাথাব্যথা
চিন বরবারই সীমান্ত নিয়ে আগ্রাসী মনোভাব নিয়ে চলেছে। শুধু মাত্র ভারতের সঙ্গেই নয়, এমনকী রাশিয়া, জাপান, তায়ওয়ান, ভুটান – প্রত্যেকটি প্রতিবেশী দেশের কোনও না কোনও অংশকে নিজের বলে দাবি করে। এবং শুধু দাবিই নয়, বেজিং মাঝে মধ্যেই তার ক্ষমতা দেখানোর চেষ্টা করে।
অরুণাচল নিয়ে চিনের মাথাব্যথার সবথেকে বড় কারণ হল দলাই লামা। তিব্বতীরা এই দলাই লামাকেই তাঁদের প্রকৃত অভিভাবক বলে মনে করে। কিন্তু চিন যখন ১৯৫১ সালে নতুন করে তিব্বতের ওপর হামলা করে তখন দলাই লামা ভারতে আশ্রয় নেন। সেই সঙ্গে বহু তিব্বতী শরণার্থী হিসেবে ভারতে চলে আসেন।
সেই সময়ে ভারতের প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরু দলাই লামাকে শুধু স্বাগত জানিয়েই থেমে থাকেন নি, তিব্বতীদের জন্য বিশেষ জায়গার ব্যবস্থা করে দেন। যে জায়গায় তিব্বতীরা এখনও দলাই লামার নেতৃত্বে ‘সেন্ট্রাল তিব্বতিয়ান অ্যাডমিনিস্ট্রেশন’ গঠন করে তাঁদের স্বাধীন সরকার চালায়।
তিব্বতীরা এখনও দলাই লামার নেতৃত্বে তিব্বতের স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখেন। তাঁরা ভাবেন, একদিন না একদিন ভারত নিশ্চয় চিনের দখলদারির হাত থেকে তিব্বতকে রক্ষা করবে। সেই স্বপ্ন নিয়ে আজও দলাই লামার সঙ্গে তিব্বতীরা ভারতে দিন কাটাচ্ছেন। এবং সারাবিশ্বে তিব্বতের ওপর ১৯৫১ সালে চিনা হামলার প্রতিবাদ করে থাকেন।
স্বাভাবিকভাবেই চিন মনে করে, ভারত সুযোগ পেলেই তিব্বতকে চিনের দখল মুক্ত করার চেষ্টা করবে। অরুণাচলের বেশিরভাগ মানুষের সঙ্গে তিব্বতের সংস্কৃতির মিল রয়েছে। ভবিষ্যতে সেই মিলকে হাতিয়ার করে ভারত চিনকে ভবিষ্যতে বেকায়দায় ফেলতে পারে। এই দুশ্চিন্তা যতই চিনকে কুরে কুরে খাচ্ছে, ততই চিন চাইছে হিমালয় লাগোয়া সমস্ত এলাকাকে নিজের দখলে করতে।
চিনের পাঁচ আঙুল রণনীতি
চিনের কুইং রাজবংশ শুধুমাত্র তিব্বতকে দখল করেই সন্তুষ্ট থাকেনি। তারা চেয়েছিল লাদাখ, নেপাল, সিকিম, ভুটান ও অরুণাচল প্রদেশকেও দখল করতে। কিন্তু কুইং রাজবংশের সেই স্বপ্ন পূরণ না হলেও ১৯৫১ সালে তিব্বত পুণরায় দখল করার পর চিন ফের সেই স্বপ্ন দেখতে শুরু করে।
যার পরিণাম ১৯৬২ সালের ভারত-চিন যুদ্ধ। ভারতের প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরু চেয়েছিলেন চিনের সঙ্গে শান্তির সম্পর্ক তৈরি করতে। সেজন্য তিনি ‘হিন্দি-চিনি ভাই ভাই’-স্লোগান তুলে চিনের সঙ্গে ১৯৫৪ সালের ২৯ এপ্রিল ‘পঞ্চশীল চুক্তি’ সাক্ষর করেন। এতে মূল পাঁচটি বিষয়কে রাখা হয়েছিল।
পঞ্চশীল চুক্তিতে ভারত ও চিন মূলত ৫টি বিষয়ে একমত হয়েছিল। কেউ কারও দেশের সার্বভৌমত্বে আঘাত হানবে না। মানে আক্রমণ করবে না। কেউ কারও দেশের অভ্যন্তরীন বিষয়ে নাক গলাবে না। একে ওপরের বিরুদ্ধে কেউ আগ্রাসন করবে না। দুই দেশ একে ওপরের উন্নয়নের জন্য সাহায্য করবে এবং ভারত ও চিন ভাই ভাইয়ের মতো থাকবে।
কিন্তু এই চুক্তির ৮ বছর কাটতে না কাটতেই চিন ভারতের পিঠে ছুরি মেরে বসে। আচমকাই লাদাখ ও অরুণাচল প্রদেশে হামলা করে বসে। সেই সময়ে আর্থিক ও সামরিকভাবে দুর্বল ভারত অরুণাচল প্রদেশ বাঁচাতে পারলেও লাদাখের কিছু অঞ্চল হারিয়ে বসে। যে অঞ্চলকে দখল করে চিন তার নতুন নামকরণ করে আকসাই চিন।
চিনের ২ বছর পরেই সুযোগ বুঝে পাকিস্তানও ভারতকে ১৯৬৫ সালে আক্রমণ করে বসে। কিন্তু ভারত সেবার পাকিস্তানকে এমন ধোলাই করে যে চিন দেখে থ হয়ে যায়। সেই বছরই অরুণাচলে চিনা লাল ফৌজ ও ভারতীয় সেনার মধ্যে সীমানায় কাঁটাতার লাগানো নিয়ে ফের লড়াই হয়। কিন্তু এবার ভারতীয় জওয়ানরা চিনা ফৌজকে হাড়ে হাড়ে বুঝিয়ে দেয় ১৯৬২‘র আর পুনরাবৃত্তি হবে না।
চিনও বুঝতে পারে ভারতের সঙ্গে লড়াই করে লাদাখ, নেপাল, ভুটান, সিকিম ও অরুণাচল দখল করতে হলে আরও শক্তিশালী হতে হবে। এরপরই চিন নিজের আর্থিক উন্নয়নের দিকে নজর দিতে শুরু করে। সেই লক্ষ্যে চিন সফলও হয়। ভারতের এক বছর স্বাধীনতা অর্জন করে ভারত সারাবিশ্বে আমেরিকার পরেই দ্বিতীয় আর্থিক শক্তি হিসেবে উঠে আসে।
এদিকে, ভারতের অর্থনীতি ধুকিয়ে ধুকিয়ে চলতে থাকে। এবং ১৯৯১ সালে কংগ্রেস পার্টির চক্করে প্রায় ভিখারি হয়ে যায়। সেই সময় ভারতের কাছে মোটে ১৩ দিনের টাকা মজুত ছিল। এই পরিস্থিতিতে অর্থনীতি বাঁচাতে আজকের পাকিস্তানের মতোই আইএমএফের কাছে টাকা চায় ভারত।
এই ঘটনা থেকে শিক্ষা নিয়ে ভারত তার আর্থিক নীতি বদল করে ফেলে। ধীরে ধীরে ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করে। কিন্তু চিন ততদিনে সারাবিশ্বের ফ্যাক্টরি হয়ে দাঁড়ায়। ভারতের মতো দেশকে তো বটেই, রাশিয়া ও ইউরোপিয়ান দেশগুলিকে পিছনে ফেলে নব্বুইয়ের দশকে চিন হয়ে ওঠে বিশ্বের অপর আর্থিক মহাশক্তি।
আর তারপরই চিন ফের ভারতকে খোঁচাতে শুরু করে। লাদাখ, অরুণাচলের মতো এলাকায় চিনা লালফৌজ লাইন অফ অ্যাকচুয়াল কন্ট্রোল (LAC) পেরিয়ে ধীরে ধীরে ভারতের জমি দখল করতে শুরু করে। কিন্তু এরপর ভারতেও পালাবদল ঘটে যায়।
মনমোহন সিংয়ের জায়গায় প্রধানমন্ত্রী হন নরেন্দ্র মোদী। আর এই নরেন্দ্র মোদীর সময়েই চিন এলএসিতে লুকোচুরি খেলতে গিয়ে ফের বড় ধাক্কা খায়। ২০২০ সালে গালওয়ানের ঘটনা ঘটে যায়। চিনকে আরও একবার ভারত বুঝিয়ে দেয়, তুমি যতবড়ই টাকার মালিক হও না কেন, আমাদের জওয়ানরা এক ইঞ্চি জমিও ছাড়বে না।
চিনের সামনে নতুন সমস্যা
আর্থিক মহাশক্তি হওয়ার পর থেকেই চিনের রাষ্ট্রপতিরা তক্কে তক্কে ছিলেন। কিন্তু পঞ্চশীল চুক্তি এবং বাণিজ্যিক কারণে তাঁরা ভারতের ল্যাজে পা দেওয়ার সাহস পাচ্ছিলেন না। হাজার হোক, ভারতের মতো চিনামাল বিক্রির বাজার সারাবিশ্বে আর কোথাও ছিল না।
কিন্তু তাল কাটালেন শি জিংপিন। তিনি চিনা রাষ্ট্রপতির পদে বসার পরই ভাবলেন, আভি নহি তো কভি নহি। ভারতে নরেন্দ্র মোদী এসে গেছে। ভারত জেগে উঠেছে। এরপর বেশি দেরি করলে আর পাঁচআঙুল রণনীতি সফল হবে না।
মোদীকে বুঝতে জিংপিন প্রথমে ২০১৭ সালে ভুটানের ডোকলাম এলাকায় পা বাড়ানোর চেষ্টা করলেন। ভাবলেন ভুটানকে দিয়েই খেলা শুরু হোক। কিন্তু ভারতীয় সেনা ভুটানে গিয়ে চিনা লালফৌজের চোখে চোখ রেখে দাঁড়িয়ে গেল। আবার কিছুটা অপেক্ষা।
এরপর ২০২০ সালের ১৫ জুন রাতের অন্ধকারে লাদাখের গালওয়ানে লাল ফৌজ ঢোকার চেষ্টা করল। কিন্তু সেখানেও ভারতীয় জওয়ানরা এমন টক্কর দিলেন যে চিনা লাল ফৌজকে পিছনে হটতে হল। ৩৮ জন ভারতীয় জওয়ান শহিদ হল বটে, কিন্তু চিনা লাল ফৌজ কতজন মরল কেউ জানে না।
চিন আজও স্বীকার করেনি গালওয়ানে কতজন লালফৌজ মারা গিয়েছিল। কিন্তু ধাক্কাটা যে মরমে লেগেছিল সেটা চিনের ছটফটানিতেই স্পষ্ট। গালওয়ানের ২ বছর পরেই ফের সেই অরুণাচল প্রদেশ। এবার অরুণাচল প্রদেশের তায়ওয়াং সীমান্তের ইয়াংসিতে প্রায় ৩০০ সেনা আচমকাই ভারতের জমি দখলের চেষ্টা করে। কিন্তু ভারতের ২০০ জওয়ান এবার তৈরি হয়েই ছিল। চিনা লালফৌজকে মার খেয়ে পিছনে ফিরতে হল।
এই ঘটনার পর চিন কিছুদিন চুপ করে থাকার পরই অরুণাচল প্রদেশের ১১টি জায়গার নাম পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত। মুখোমুখি লড়াইয়ে না পেরেই কি তবে এমন সিদ্ধান্ত? মজার কথা হল, চিন যখন এমন কান্ড করছে ঠিক তার একদিন আগে দু‘দিনের সফরে এসেছিলেন ভুটানের রাজা জিগমে কেসর নামগয়েল ওয়াংচুক।