মঙ্গলবার, জানুয়ারি 14, 2025
মঙ্গলবার, জানুয়ারি 14, 2025
HomeUncategorizedFunny Story: গোঁফওয়ালা ভাল্লুক

Funny Story: গোঁফওয়ালা ভাল্লুক

- Advertisement -

গৌতম সিনহা

বাথরুম থেকে বেরিয়ে বহুদিন পর আয়নার সামনে দাঁড়ালাম। আমার স্ত্রী রেণুকা বড়বড় চোখ করে তাকাল। মুখ ঘুরিয়ে বললাম – কী হয়েছে? বাজার থেকে কিছু আনতে হবে? রেণুকা আমার মাথার চুল থেকে পায়ের পাজামা পর্যন্ত দেখে নিয়ে বলল, ‘‘যাক তাহলে আয়নায় নিজের চেহারাটা দেখছ।’’ আমি বললাম – কেন, আয়নাটা কি শুধু তোমার জন্যই কেনা না কি! রেণুকাও কথার ঝাঁঝ বাড়িয়ে বলল, ‘‘তা আয়নায় একটা ভাল্লুক দেখতে পাচ্ছ কি?’’ তারপরই রান্নাঘরে চলে গেল। ভাবলাম একটা কড়া জবাব দিই। কিন্তু আয়নায় নিজের চেহেরা দেখে কথা আটকে গেল। তাই তো! ভালুকই বটে। পাকা-কাঁচা চুল দাঁড়ি সব আগাছার জঙ্গলের মতো মনে হচ্ছে। ওয়ার্ক ফ্রম হোমের চক্করে দেখছি আস্ত একটা জানোয়ার হয়ে গেছি। কখন খাই, কখন ঘুমোই, কখন বাজারে যাই, কখন বাথরুমে যাই কিছুই বুঝতে পারি না। সারাক্ষণ অফিসের চাপ মাথায় কাজ করে। অফিসের লোকেরা নিশ্চয় ভাবে, বাড়িতে যখন আছে নিশ্চয় বসে আছে। দে আরও পাঁচটা কাজ ধরিয়ে। পাঁচটা কাজ শেষ করার আগেই আরও দশটা জমা হয়ে যায়। অফিসে থাকলে তাও একটা জবাব দেওয়া যায়। কিন্তু এই করোনার সময় যে হারে অফিসে ছাঁটাই হচ্ছে, তাছাড়া যেভাবে বাড়িতে বসিয়ে গত ২ বছর ধরে ওয়ার্ক ফ্রম হোম করাচ্ছে, চাকরি যাওয়ার ভয়ে কিছুই বলতে পারি না। উলটে অফিসের বড়বাবুকে বলতে হয়, ‘‘দাদা আরও কিছু থাকলে বলবেন। আমি কিন্তু রয়েছি।’’ ওদিক থেকে বড়বাবুও খেলা বোঝে। আরও দুটো কাজ খুঁজে এনে আমার ঘাড়েই চাপিয়ে দেয়। এই করে সংসারধর্ম প্রায় লাটে উঠেছে। রেণুকা প্রথম দিকে খেচর খেচর করত। দু’মাস পরে বুঝে গিয়েছে – এই জানোয়ারটার সঙ্গেই ঘর করতে হবে। সুতরাং নতুন করে মাথা ঘামিয়ে লাভ কি! কিন্তু এতদিন পর যখন আচমকাই আয়নার সামনে দাঁড়ালাম রেণুকা আসল কথাটা বলেই দিল। সত্যিই চুল-দাঁড়ি-গোফে ভালুক ভালুক বলে মনে হচ্ছে। ভাবলাম, নাহ – চুল দাঁড়িটা কাটাতেই হবে। বাজারের ব্যাগ হাতে বেরোচ্ছি, ঠিক তখনই রেণুকা হাক দিল – কোথায় চললে? পালটা উত্তরটা তখন দিতে পারিনি। এবার দিলাম। বললাম – জঙ্গলে।

রাস্তায় বেরিয়েই মনে হল, লোকে চিনতে পারবে তো? দেখলাম আমাকে কিংবা আমার চুল-দাঁড়ি নিয়ে পাড়া প্রতিবেশীদের কোনও মাথাব্যথা নেই। যারই চোখে চোখ পড়ছে, মুচকি হেসে পাশ কাটিয়ে চলে যাচ্ছে। আমার পাড়ার সেলুনটা হাঁটাপথ। মাঝামাঝি জায়গায় পৌঁছতেই পাড়ার সুবুপাগলা আমাকে ধরে ফেলল। ভাল নাম সুবল। দারুন ছাত্র ছিল। প্রেসিডেন্সি থেকে না কি গোল্ড মেডেলও পেয়েছে। কিন্তু তারপর কী হল কে জানে। হঠাৎ পাগলা হয়ে গেল। কেউ বলে মাথাছিট। বেশি পড়াশোনা করে না কি মাথাছিট হয়ে গিয়েছে সুবলের। মাঝে মাঝে আমারও মনে হয় – আমিও একদিন কাজ আর সংসারের চাপে এই ভাবে সুবু পাগলার মতো রাস্তায় দাঁড়িয়ে দাঁত কেলিয়ে হাসব। সেই দিন এল বলে। সুবু দাঁত কেলিয়ে আমার কাছে এল। ‘‘দাদা, একটা পয়সা দেবে?’’ সুবুর মাথা খারাপ হলেও পাড়ার বেশিরভাগ মানুষই ভালোবাসে। হয়তো এক সময় পড়াশোনায় দারুন ছিল বলে সবার মনে একটা সমীহ থেকে গেছে। আমারও সমীহ হয়। আহা রে, এমন একটা সোনার ছেলে। শেষে কি না পাগলা হয়ে গেল। দেশ একজন সোনার মাণিককে হারাল। হতে পারত সুবু দেশের একজন বিজ্ঞানী হত, কিংবা একজন আইএএস অফিসার। নিদেন পক্ষে নামি কলেজের দামি অধ্যাপক তো হতোই। আমার মতো তো আর কলম পেষা কেরাণি হত না। সুতরাং সমীহ না করে উপায় থাকে না। পকেট থেকে একটা ৫টাকার কয়েন বের করতে করতে জিজ্ঞেস করলাম – কীরে সুবু, কী করবি পয়সা দিয়ে? সুবু অন্যদিকে চেয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল। আনমনে দূরের কৃষ্ণচূড়া গাছটার লালফুল গুলো দেখতে থাকল। আমি যে সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছি, ওর খেয়ালই নেই। কৃষ্ণচূড়ার টকটকে লালফুল গুলো দেখছে আর – হু হু করে কী যেন হিসেব করছে। আমি পড়লাম মহাফাঁপড়ে। বললাম, টাকা নিবি না? সুবু পাগলা তাও কথা বলে না। ভাবছি কী করব। পাঁচ টাকার কয়েনটা ফের পকেটে ঢুকিয়ে ফেলব না বের যখন করেছি সুবুকে দিয়েই যাব? এমন সময় সুবু কৃষ্ণচূড়া গাছটার দিকে তাকিয়েই দাঁত কেলিয়ে হাসতে শুরু করল। আমার দিকে না তাকিয়েই বলল – দারুণ। অস্বস্তি এড়াতে আমি বললাম, কৃষ্ণচূড়া গাছে ফুল ফুটলে দারুণ তো লাগবেই। সুবু পাগলা সেভাবেই দাঁত কেলিয়ে হেসে হেসে বলল, তোমার দাড়ি গোঁফ দারুণ। মাথাটা চরাত করে গরম হয়ে গেল। এ দেখছি আচ্ছা পাগলা। আমাকে নিয়ে মস্করা করছে। অন্তত দু’ থেকে তিনমাস আগে আমাকে দেখেছে। সে সময় আমার এত দাড়ি গোঁফের জঙ্গল ছিল না। কিন্তু ব্যাটা ঠিক আমার আগের চেহেরাটা মাথায় রেখেছে। বেশ রেগে গিয়েই বললাম, পয়সাটা নিবি না আমি যাব? সুবু পাগলা হাসতে হাসতে অন্যদিকে চলে গেল। অপমানিত বোধ করলাম। কিন্তু কি আর করা যাবে – ওই যে কথায় আছে না, পাগলে কী না বলে, ছাগলে কি না খায়। সুতরাং নিজের রাগ নিজেকেই গিলতে হল।

বাজারের থলিটা মুচরে সেলুনের দিকে হাঁটা দিলাম। নিতাই দোকানে তখন একজন দাড়ি কামাচ্ছে। আমি গিয়ে প্রথমেই জানতে চাইলাম – ক’জন আছে রে? নিতাইও আমার মাথা থেকে পা পর্যন্ত প্রথমে দেখল। তারপর জানতে চাইল – কী করবেন? বোঝো ঠ্যালা। আরে তোর সেলুনে এসেছি মানে চুল দাঁড়িই তো কামাব। না কি তোর দোকানে আমি বসে বসে খই ভাজব? আজ দিনটাই দেখছি মাটি হবে। প্রথমে রেণুকা, তারপর সুবুপাগলা এখন দেখছি নিতাই আমাকে নিয়ে পড়েছে। কী কুক্ষণে যে আয়নায় নিজের মুখ দেখতে গিয়েছিলাম। কিছুটা অভিমানের সুরেই নেতাইকে বললাম, আরে ভাই দেখছিস না চুল-দাঁড়িতে ভাল্লুক হয়ে গেছি। এগুলো কাটাব। নেতাই ইশারায় পাশের খালি চেয়ারটা দেখিয়ে দিল। মানে হল – ওহ এই ব্যাপার! ঠিক আছে বসুন। চেয়ারটাতে বসেছি কি বসিনি – পাশের ভদ্রলোক বলে উঠলেন ‘‘আরে দাদা এত্তবড় চুল-দাঁড়ি রাখেন কিভাবে? আমার তো কুচকুচ করে চুলকায়।’’ এ দেখছি আরেক জ্বালা। আরেক পাগল। কে কতবড় চুল-দাঁড়ি রাখবে সেটাও কি এরা ঠিক করে দেবে না কি? চুপ করে আছি দেখে ভদ্রলোক ফের ফোঁড়ন কাটলেন, ‘‘দাদা আমাকে বুঝি চিনতে পারলেন না। আরে আমি রজতাভ। আপনার উলটো দিকের ফ্ল্যাটে থাকি। বৌদির সঙ্গে তো মাঝে মাঝেই কথা হয়।’’ এই রে, ব্যাটা তো আসল খিলারি দেখছি। দুপুরের বৌদির চুল-দাঁড়ি ছাঁটাই করা প্রকৃত দেওর। আমি বাড়িতে থাকার পরেও কথা হচ্ছে। আমি যখন অফিসে যেতাম তখন আরও কিছু ….. ছি ছি এ কী ভাবছি। নিজের স্ত্রী নিয়ে এমন ভাবনা! একেবারে দেখছি লম্পটের পর্যায়ে নেমে যাচ্ছি। সত্যিই চুল-দাঁড়ির আড়ালে আমার ওপর জানোয়ার ভর করেছে। ভদ্রভাবে রজতাভকে বললাম, না না, আসলে এতদিন সময় পাই নি তো? তাই একটু জঙ্গলের মতো দেখাচ্ছে। তা আপনার খবর কি? রজতাভের দাঁড়ি কামানো হয়ে গিয়েছিল। নিতাই ওর চেয়ারটাই আমাকে বসতে বলে খুর ধুতে লাগল। রজতাভ আয়নায় নিজের চকচকে মুখ আর কলপ করা চুলের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘‘যো দিখতা হ্যায়, ওহি বিকতা হ্যায়। নিজেকে একটু ফিটফাট না রাখুন। না হলে বৌদি পাড়াপড়শিকে মুখ দেখাবে কী করে। আজকে চলি, তাড়া আছে। অন্যদিন কথা হবে।’’ বলেই ঝড়ের গতিতে বেরিয়ে গেল।

নিতাইকে বললাম, মালটা কে রে? নিতাই বলল, ‘‘আরে আপনার পাড়ার ছেলে। কোন একটা কোম্পানিতে মার্কেটিংয়ের কাজ করে। রোজ কাজে যাওয়ার আগে আমার কাছে দাঁড়িটা কাটিয়ে যায়।’’ মনে মনে বললাম, ‘‘ওহ এই ব্যাপার। তাই শালা আমাকে ফিটফাট থাকার জ্ঞাণ দিচ্ছিল। করিস তো মাল বিক্রি। আমার মতো তো আর ঘরে বসে কাজ করলে তোরও রোজ দাঁড়ি চাঁচার দরকার পড়ত না।’’ নিতাই জানতে চাইল, ‘‘দাদা সব সাফ করে দেব?’’ ক্ষেপে গিয়ে বললাম, সঅঅব সাআআফ করে দে। কিচ্ছু রাখবি না। দে জঙ্গল সাফ করে। একটা আগাছাও রাখবি না। নিতাই কী বুঝল জানিনা, দিল কচকচ করে আমার মাথায় কাঁচি চালিয়ে। চোখ বন্ধ করে আমি শুধু ভাবছি, রেণুকা এই মালটার সঙ্গে লাইন মারে না তো? আরে ঠিক আছে, বেশি বলে ফেললাম। চোখ তুলে তো দেখে? চটকদারি মালে ছেলেরাই চোখ ঘোরাতে পারে না, মেয়েদের চোখ তো যাবেই। ভাগ্যিস মালটার কথায় গোপন তথ্য পেয়ে গেলাম। না হলে চাকরি বাঁচাতে গিয়ে ঘরের বউ-ই হয়তো কিছুদিন পরে এই মার্কেটিং ছোড়াটার সঙ্গে দহরম মহরম শুরু করে দিত। নাহ, এর একটা হেস্ত-নেস্ত করতে হবে। আজকেই করতে হবে। বহুদিন পর আজ অফিস ছুটি পেয়েছি। আয়নায় নিজের মুখ যখন দেখেছি। আজ রেণুকাকেও আয়নার সামনে দাঁড় করাব। এই ছোড়া আমাকে হারিয়ে দেবে এটা হতে দেব না। এই সব সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে কখন চুল দাঁড়ি সাফ হয়ে গিয়েছে, টেরই পাইনি। নিতাই আওয়াজে সম্বিত ফিরে পেলাম। ‘‘দাদা, সব সাফ। আর কিছু?’’ বললাম – এতেই হবে। কত হল?

নিতাইকে টাকা দিয়ে বাজারের পথে হাঁটতে শুরু করলাম। কী করা যায়? রেণুকাকে আয়নার সামনে দাঁড় করানোর জন্য কী করা যায়। শরৎ চাটুর্জ্জে লিখে গেছেন, বিশ্বাস ক যদি ঠকতে হয়, তাহলে তা অবিশ্বাসের পাপের থেকে অনেক ভাল। কথাগুলোর ব্যাখ্যা আরও একবার নিজের মনে ঝালিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করলাম। রেণুকাকে বিশ্বাস করেও যদি আমি ঠকি তাও ঠিক আছে। কিন্তু অবিশ্বাস করে যদি আয়নার সামনে দাঁড় করায়, আর সে যদি এই ছোকরার প্রতি কোনও দুর্বলতা কখনও না দেখিয়ে থাকে – তাহলে কিন্তু আমার নিজের স্ত্রীকে করা সন্দেহের পাপ আমার ছোট্ট সংসারে আগুন ধরাবে। বড্ড রিস্ক হয়ে যাচ্ছে। এত সব ভাবতে গিয়ে রাস্তায় হোঁচট খেলাম। একজন ধরে ফেলল। ‘‘আরে প্রতীকদা যে! কী খবর? একটু দেখে হাঁটবে তো?’’ মুখ তুলে তাকিয়ে দেখি সামনে অঞ্জন। আমার পাড়াতেই থাকে। বাজার সেরে ফিরছে। অঞ্জন জানতে চাইল – লেগেছে কি না? বললাম, একটু লেগেছে ঠিকই। কিন্তু ও সামলে নিতে পারব। কোথায় লেগেছে সেটা আর বললাম না। অঞ্জন চলে যেতে যেতে ফের বলল, ‘‘প্রতীকদা, তোমাকে আজ দারুণ দেখাচ্ছে তো? একেবারে চকচক করছ। আজকাল বৌদি তোমাকে বাড়িতে পেয়ে একটু বেশিই আদর করছে বুঝি!’’ অঞ্জন ওই রকমই। রেণুকার সঙ্গেও ওর সম্পর্ক ভালো। মাঝে মাঝে ওর স্ত্রীকে নিয়ে এসে আমার বাড়িতে আড্ডা মেরে যায়। কিন্তু সেই আড্ডায় আমার থাকা হয় না। ওই যে কাজের চাপ! কিন্তু অঞ্জনের নিজের ব্যবসা আছে। গাড়ির ব্যবসা। পৈতৃক সম্পত্তিও প্রচুর। সুতরাং বেশ হেসে খেলে কাটানো জীবন। আমার মতো চাকুরিজীবী না। উত্তরে বললাম, ‘‘আদর তো তুইও কম পাস না। পারলে চলে আয় আজকে। আমার ছুটি। আড্ডা দেওয়া যাবে।’’ অঞ্জন হাসতে হাসতে বলল, ‘‘না দাদা, আজকে সন্ধ্যায় নর্থ বেঙ্গলে যাব। চায়ের একটা বাগিচা কেনার শখ হয়েছে। কেনা হয়ে গেলে তোমাকে আর বৌদিকে নিয়ে আমরাও যাব ঘুরতে। তখন আড্ডা হবে।’’ অঞ্জন চলে গেল। দেখি আমার মনটাও বেশ ভাল লাগছে। বেশ একটা উরুউরু ভাব এসে গেছে। বাজারে ঢুকেই মনে হল – আজ আর মাছ না। কবেরাজি খাসির মাংস কেনা যাক। রেণুকার হাতে খাসির মাংস খেয়েই তো অঞ্জনদের সঙ্গে সম্পর্কটা হল। তা না হলে আমাদের এই পাড়ায় চিনত কে?

বেশ গুছিয়ে বাজার করে বাড়ি ফিরলাম। আমাকে দেখেও রেণুকা যেন দেখল না। মনটা একটু দমে গেল। চুল-দাঁড়ি সব সাফ করে এলাম, এরপরেও কী আমাকে ভাল্লুকই মনে হচ্ছে? না কি অন্যকিছু? ছ্যাক করে ফের সেই সেলুনের মার্কেটিং ছোড়াটার কথা মাথায় চলে এল। না না – কিছু একটা ব্যাপার আছে। দেখতে হবে দেখছি। বাজারের থলেটা প্রায় রেণুকার গায়ে ছুড়ে দিয়েই স্নানে চলে গেলাম। আমার মাথায় দ্বিগুণ বেগে সন্দেহ দানা বাঁধতে শুরু করেছে। অঞ্জনের সঙ্গে দেখা হওয়ার পর যে ভালমনের ভাবটা এসেছিল – সেটাকে কেউ ছিঁড়েখুড়ে খেয়ে নিয়েছে। আমার মাথায় এখন তাণ্ডব করছে সন্দেহ। সন্দেহ আর সন্দেহ। স্নান সেরেই শুকনো কাপড় পড়ে বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়লাম। অফিসের কাজের ক্লান্তি আর অভিমানের জ্বালায় কখন দুচোখে ঘুম নেমে এল – বুঝতেই পারলাম না। দুপুরের আবছা ঘুমে স্বপ্ন দেখলাম, কাপড় শুকোতে দিতে গিয়ে ওই মার্কেটিং ছোড়ার সঙ্গে বেশ রসিয়ে রসিয়ে গল্প করছে রেণুকা। আমি সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছি অথচ পাত্তায় দিচ্ছে না। চোখ দিয়ে জল বেরিয়ে এল। আমার এত ভালোবাসাকে রেণুকা এত সহজে মারিয়ে দিল। এত সহজে ভুলে গেল – এই চাকরি পাওয়ার আগে দু‘জনে কী না কষ্ট করেছি। রেণুকা চাইলে আমার থেকে ভালো বর পেতেই পারত। ওর বাবার বিশাল ব্যবসা। একজন অন্তত বড় অফিসারের সঙ্গে মেয়ের বিয়ে দিতেই পারত। কিন্তু রেণুকায় জিদ ধরেছিল – আমাকে ছাড়া ও জীবনে কাউকে বিয়ে করবে না। ব্যবসায়ী বাবা যদি আমাকে মেনে না নেয়, সারাজীবন অবিবাহিতই থাকবে। শেষে মেয়ের জেদের সামনে ঝুকতে বাধ্য হয়েছিলেন রেণুকার ব্যবসায়ী বাবা। কিন্তু রেণুকা এখন কী করছে? তাহলে রেণুকার ভালোবাসার মানুষ কী বদলে গেল? চোখ দিয়ে জল ঝরনার মতো বেরোচ্ছে। পিছন থেকে অঞ্জন হাত ধরে টানছে। আর বলছে, ‘‘প্রতীকদা, চলো আমাদের উত্তরবঙ্গের চায়ের বাগানে। ওখানেই তুমি ভালো থাকবে।’’ প্রতীক হাত টানছে। আমি তা ছাড়িয়ে নিচ্ছি। ফের হাতে টান। ফের হাত ছাড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টা। এমন ঘুমটা আচমকাই ভেঙে গেল। দেখি রেণুকা হাত ধরে টানছে। বলছে, ‘‘ওভাবে গো গো করছ কেন? কী হয়েছে তোমার?’’ চোখের সামনে রেণুকাকে দেখেই ফের অভিমানের মেঘটা ঝপ করে নেমে বৃষ্টি ঝরাতে শুরু করল। রেণুকা উদগ্রীব হয়ে বলল, ‘‘কী হয়েছে তোমার? কেন এমন করছ?’’ গোমরা হয়ে বিছানাতেই শুয়ে থাকলাম। রেণুকা এবার আস্তে করে বলল, ‘‘মাংস রান্না করেছি। খাবে না?’’ আমার মুখ দিয়ে শুধু বেরল – নাহ।

সারাদিন আমার বিছানাতেই কেটে গেল। সন্ধ্যের শাঁখ আর ধূপের গন্ধে উঠে পড়লাম। চুপচাপ ছাদে গিয়ে সিগারেট টানতে লাগলাম। আকাশের দিকে তাকালাম। আজ নির্ঘাত পূর্ণিমা। না হলে এখনই চাঁদ উঠে এত জ্বলজ্বল করবে কেন? মায়ের কথা মনে পড়ে গেল। গ্রামের বাড়িতে এখন মা একা একা কী করছে? নিশ্চয় গোয়াল ঘরে গিয়ে গরুর বাছুরটাকে মশারি টাঙিয়ে দিচ্ছে। যে হারে মশা বেড়েছে বিচুলির ধুঁয়োতে কিছুই হবে না। মাকে আনতে চেয়ে রেণুকাই বহুবার বায়না ধরেছে। আমারও মনে হয়েছে – মাকে গ্রামের বাড়ি থেকে এখানে আনায় যায়। কিন্তু গ্রামের পরিবেশ ছেড়ে মা এখানে থাকতে পারবেন তো? বাবা মারা যাওয়ার পর গরু-বাছুর-ছাগলই এখন তাঁর সংসার। বাবার পেনশনটা মায়ের রয়েছে। সেই দিয়ে দেখা-শোনার জন্য কমলি আর রাধুকে রাখা হয়েছে। মাঝে মাঝে টাকার দরকার পড়লে আমিও দিই। কিন্তু গ্রামের জীবন থেকে মাকে উপড়ে নিয়ে শহরের ফুলদানিতে তোলাফুলের মতো রাখার সাহস আমার হয় না। ওভাবে রাখলে মা হয়তো বেশিদিন বাঁচবেই না। একথা রেণুকা বলার পর থেকেই ও মা কে এখানে এনে রাখার বায়না ছেড়েছে। মনটা কেমন হুহু করে উঠল। জীবন কিভাবে দেখতে দেখতে পালটে গেল। মা আমার জন্য এতকিছু করল, কিন্তু আমি মায়ের জন্য কিছু করতে পারলাম কি? রেণুকাও তো বাঁধা দেয়নি। বরং জোর করেছিল মায়ের জন্য। তারপরেও আমি পারিনি। চাকরির চাপে মায়ের সঙ্গেও ঠিকমতো কথা হয় না। যতটুকু খোঁজখবর, রেণুকায় নেয়। আমার মনের অভিমানের মেঘ সরে গিয়ে আবেগের হাওয়া বইতে লাগল। রেণুকা রেণুকা – তুমি আর মা আমার জন্য অনেক করেছ। কিন্তু আমি কারোর জন্যই কিছু করতে পারলাম না। শুধু চাকরি বাঁচাব বলে লড়ে যাচ্ছি। আমাকে তোমরা ক্ষমা করো। ফের চোখ ঝাপসা হয়ে এল। হঠাৎ কাঁধে হাত পড়ল। জানি এই হাত কার।

দু‘জনে মিলেই দুপুরের ফেলে রাখা মাংসভাত খেলাম। রেণুকাও সারাদিন না খেয়ে ছিল। আমি খাইনি বলে। দু’জনে মিলে বহুদিন পর বিছানায় বসে ল্যাপটপে একটা উত্তম-সূচিত্রার প্রেমের সিনেমা দেখলাম। রেণুকা গায়ের চাদরটা দিয়ে একসময় আমাকে জড়িয়ে নিল। সিনেমা শেষ হওয়ার আগেই রেণুকার ঠোঁটে আমার ঠোঁট ঝাঁপিয়ে পড়ল। রেণুকা, আৎকে উঠল। ‘‘দাঁড়াও দাঁড়াও, ল্যাপটা ভেঙে যাবে যে।’’ ও উঠে গিয়ে ল্যাপটা ঠিক জায়গায় রেখে এল। তারপর আমাকে বুকে নিয়ে বলল, ‘‘আমার ভাল্লুক’’। আমিও গরররররর আওয়াজ তুলে রেণুকার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লাম।

                                                 সমাপ্ত                                                                                               (কপিরাইট – পারফেক্ট পলিটিক্স)

আরও খবর
- Advertisment -

সবাই যা পড়ছেন

পছন্দের খবর