Homeবৈঠকচুলোয় যাক বাঙালির ভবিষ্যৎ, পাঞ্জাবী না কি খালিস্তানি সেই বিতর্কেই মজে বাংলা

চুলোয় যাক বাঙালির ভবিষ্যৎ, পাঞ্জাবী না কি খালিস্তানি সেই বিতর্কেই মজে বাংলা

- Advertisement -

অরণ্য রায়

পাঞ্জাবি নাকি খালিস্তানি? ওই জিজ্ঞাসে কোন জন,

বাঙালি? বল রাজনীতি ভোগে গেছে এই বাংলার

বিদ্রোহী কবির কাছে ক্ষমা চেয়েই এই লাইন দু’টো লিখতে হল। বাংলার উন্নয়ণ, বাংলার ভবিষ্যৎ, বাংলার শিল্প, বাংলার সম্পদ, বাংলার স্বাস্থ্য, বাংলার শিক্ষা, আইন-শৃঙ্খলা – সব বিতর্ক এখন বাতিল। পশ্চিমবঙ্গে এখন বিতর্ক শুরু হয়েছে পাগড়িধারী পুলিশ পাঞ্জাবী না কি খালিস্তানি – সেটা নিয়ে। এবং বিতর্ক যিনি উসকে দিয়েছেন তাঁর নাম মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনিই প্রথম তাঁর এক্স হ্যান্ডেলে একটি ভিডিও দিয়ে বিজেপির ‘জাতিবাদী’ রাজনীতির সমালোচনা করেন। এবং তারপরই তৃণমূলের নেতা-নেত্রীরা একেবারে আদা-জল খেয়ে মাঠে নেমে পড়েছেন। সেই সঙ্গে তালে তাল দিয়ে বিজেপির শুভেন্দু অধিকারী ও অগ্নিমিত্রা পালদের বিরুদ্ধে আদালতে যাওয়ার হুঁশিয়ারি দিয়ে বসেছে পুলিশও।

পাগড়িধারী পুলিশ আধিকারিককে কেউ যদি খালিস্তানি বলে, সেটা অবশ্যই সমালোচনার যোগ্য। কারণ ‘খালিস্তানি’ শব্দটার সঙ্গে ‘দেশদ্রোহী’ ব্যাপারটা জড়িয়ে রয়েছে। সুতরাং পাঞ্জাবী বা শিখ সম্প্রদায়ের মানুষদের কাছে ‘খালিস্তানি’ শব্দটা একটা গালাগালির পর্যায়ে পড়ে। আর সেই গালাগালি যদি একজন পাগড়িধারী পুলিশ আধিকারিককে খেতে হয় তাতে তাঁর ক্ষোভ হওয়ারই কথা। এবং সেই ক্ষোভ আমরা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের এক্স হ্যান্ডেলে দেওয়া ভিডিওতেও দেখতে পেয়েছি।

তবে একথাও অস্বীকার করার উপায় নেই যে পঞ্জাবের কিছু শিখ সম্প্রদায়ের মানুষ আজও ‘খালিস্তান’ বানানোর স্বপ্ন দেখে। হয়তো তাদের বেশিরভাগই আজ কানাডা, অস্ট্রেলিয়া কিংবা ব্রিটেনের মতো দেশের নাগরিক। কিন্তু তারপরেও পঞ্জাবের এক শ্রেণির মানুষের সঙ্গে খালিস্তানপন্থীদের যে একটা গোপন সম্পর্ক রয়েছে – সেটা ভারতীয় গোয়েন্দারা ভালোমতই জানেন। এবং সুযোগ পেলেই যে তা নিয়ে ষড়যন্ত্রের জাল বোনা হয় – সেটাও কারো অজানা নয়।

বলতে দ্বিধা নেই, ‘খালিস্তান’ শব্দটি শিখ সম্প্রদায়ের মানুষের কাছে একটা আঘাত। ইন্দিরা গান্ধী প্রধানমন্ত্রী থাকার সময়ে ব্লু স্টার অপারেশনের সময় শিখদের পবিত্রস্থান স্বর্ণ মন্দিরে যা ঘটেছিল – সেটা সেটা আজও কেউ ভুলতে পারেনি। আগামীদিনেও ভুলবে বলে মনে হয় না। ফলে এই আঘাত বা জখম হয়তো শিখ সম্প্রদায়ের মানুষেরা কোনও দিনই ভুলতে পারবেন না। সুতরাং কেউ যদি কর্তব্যরত পাগড়িধারী পুলিশ আধিকারিককে ‘খালিস্তানি’ বলেন – সেটা যে ওই আধিকারিকের হাড়ে বিঁধবে তা বলার অপেক্ষা রাখে না।

কিন্তু বিজেপির নেতা নেত্রীরা ওই পাগড়িধারী পুলিশ আধিকারিককে খালিস্তানি বলতে গেলেন কিসের জন্যে? যদিও এখানে স্পষ্ট করা ভাল – কে বা কারা খালিস্তানি বলেছেন তা নিয়ে পক্ষ এবং বিপক্ষর ভিন্নমত রয়েছে। তবুও তর্কের খাতিরে যদি ধরে নেওয়ায় যায় বিজেপির নেতা-নেত্রী কিংবা কর্মী-সমর্থকরা ওই পাগড়িধারী পুলিশ আধিকারিককে খালিস্তানি বলেছেন তাহলে প্রশ্ন উঠছে – কেন তারা এমনটা করলেন?

উত্তরে বলতে হয়, দেশের খেয়ে যেভাবে রাজ্যপুলিশের কিছু আধিকারিক রাজ্যের তৃণমূল সরকারের স্বার্থরক্ষায় সন্দেশখালির শেখ সাজাহানের মতো সমাজ বিরোধীদের ‘বাঁচানোর’ চেষ্টা করছে – সেটাই বোঝাতে গিয়ে এই খালিস্তানি শব্দটা ব্যবহার করে থাকতে পারেন বিজেপির নেতা-নেত্রীরা। এমনটা নয় যে বিজেপির নেতা-নেত্রীরা এই দেশ বিরোধী তকমাটা পশ্চিমবঙ্গে প্রথমবার কারও বিরুদ্ধে ব্যবহার করছেন। এমনকী খোদ রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধেও শুভেন্দু অধিকারীদের একথা বলতে শোনা গিয়েছে যে তৃণমূল নেত্রী আসলে পশ্চিমবঙ্গকে আলাদা দেশ হিসেবে দেখাতে চাইছে। এই কথা বলার সময় প্রসঙ্গক্রমে কাশ্মীরের উদাহরণও বহুবার বিজেপি নেতাদের দিতে দেখা গিয়েছে।

মজার কথা হল, এনিয়ে কখনও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কিন্তু কোনও প্রতিবাদ করেন নি। কখনও মুখ ফুটে বলেননি যে পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে কাশ্মীরের তুলনা টানা একটা গর্হিত কাজ। এই কাজ যে করবে বা করেছে তার বিরুদ্ধে আদালতে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে। বরং তার বদলে ‘জয় বাংলা’ স্লোগানটাকে আরও বেশি করে ব্যবহার করা শুরু করেছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়রা। এবং দিল্লির মোদী সরকারের সঙ্গে টক্কর দিয়ে সমান্তরালভাবে পশ্চিমবঙ্গে প্রায় আলাদা একটা প্রশাসনিক ব্যবস্থাও গড়ে তোলার চেষ্টা শুরু হয়ে গিয়েছে। যার অতি সাম্প্রতিক উদাহরণ আধারকার্ড। কেন্দ্র আধারকার্ড বাতিল করলে রাজ্যের তৃণমূল সরকার পালটা আধার কার্ডের মতো কার্ড দেবে – এমনটা নবান্নে বসে সগর্বে ঘোষণা করেছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।

আর এখানেই প্রশ্ন উঠছে, খোদ মমতাকে যখন বিজেপির নেতা-নেত্রীরা ‘দেশদ্রোহী’ বলে আক্রমণ করে তখন তৃণমূল নেত্রী কোনও কথা বলেন না। কিন্তু পাগড়িধারী পুলিশ আধিকারিককে ‘দেশদ্রোহী’ বলতেই তিনি ফুঁসে ওঠেন। এবং রীতিমতো এক্স হ্যান্ডেলে ভিডিও দিয়ে তৃণমূলকে এর বিরুদ্ধে মাঠে নামার নির্দেশ দিয়ে বসেন। এর পিছনে কোন রহস্য কাজ করছে?

রহস্যটা হল রাজনীতি। সন্দেশখালি আর শেখ সাজাহান নিয়ে তৃণমূল সরকার এখন রীতিমতো ব্যাকফুটে। শত চেষ্টা করেও সন্দেশখালির পরিস্থিতি সামাল দেওয়া যাচ্ছে না। শুভেন্দু অধিকারী, অগ্নিমিত্রা পালেদের আটকানো যাচ্ছে না। এই পরিস্থিতিতে ‘খালিস্তানি’ শব্দটাকে হাতিয়ার করে নজর ঘোরানোর চেষ্টা করা স্বাভাবিক নয় কি? পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতির যা পরিস্থিতি তাতে এক বিতর্ক ঢাকতে আইন-আদালত নয়, পালটা বিতর্কই দরকার। সুতরাং মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর রাজনৈতিক স্বার্থরক্ষায় সেটাই করেছেন। সন্দেশখালির পালটা হিসেবে খালিস্তানিকে হাতিয়ার বানিয়েছেন।

এই বাংলায় শিখ সম্প্রদায়ের মানুষের সংখ্যা হাতে গোনা। শতাংশের হিসেবে দুই কিংবা তিন হবে। কিন্তু সেই দুই কিংবা তিন শতাংশ ভোটারকে এখন তৃণমূল হারাতে চায় না। কেননা, বিজেপির সঙ্গে লড়াইটা প্রায় সমানে সমানে এসে দাঁড়িয়েছে। যে কারণে মমতা পশ্চিমবঙ্গের শিখ সম্প্রদায়ের মানুষদের আলাদা করে গুরুত্ব দেন। কিন্তু বিজেপির জন্য ব্যাপারটা একটু অন্যরকম। কেননা, পঞ্জাব-হরিয়ানা কিংবা দিল্লিতে তৃণমূল না থাকলেও বিজেপি রয়েছে। বিজেপি এই রাজ্যগুলিতে ক্ষমতা ধরে রাখার কিংবা ক্ষমতায় আসার স্বপ্ন দেখে। এই পরিস্থিতি পাগড়ির অপমান বিজেপির বড় রকমের ক্ষতি করতে পারে। অন্তত পশ্চিমবঙ্গে না হোক, পঞ্জাব-হরিয়ানা কিংবা দিল্লিতে তো হবে। সুতরাং কেন্দ্রীয় বিজেপি নড়েচড়ে বসেছে।

যদিও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের জন্য এই খালিস্তানি বিতর্ক এক্কেবারে উইন উইন সিচ্যুয়েশন। এতে যত বিতর্ক বাড়বে সন্দেশখালি তত ঝিমোবে। আবার সারাদেশে শিখ সম্প্রদায়ের মানুষের কাছে বিজেপির মুখ পুড়বে। এক ঢিলে দুই পাখি মারার এমন সুযোগ কি কেউ হাতছাড়া করে! মমতাও করেননি। বলতেই হয়, চালটা ভালোই হয়েছে। কিন্তু বাংলার উন্নয়ণ, দুর্নীতি, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, শিল্পর মতো গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুগুলোর কি হবে? স্বাভাবিকভাবেই মমতা চাইবেন না এগুলো নিয়ে বিরোধীরা নাড়া-চাড়া করুক। বরং সন্দেশখালি নিয়ে যা তর্ক-বিতর্ক হচ্ছে হোক। তাতে এই খালিস্তানি এক্কেবারে সোনায় সোহাগা হয়ে গিয়েছে।

(প্রবন্ধের বক্তব্য একান্তই লেখকের নিজস্ব)

- Advertisement -
- Advertisement -
- Advertisement -
- Advertisement -