তথাগত সিংহ
মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় অভিষেক ব্যানার্জী-সহ ১০ জনকে সঙ্গে নিয়ে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গে বৈঠক করলেন। বলতে দ্বিধা নেই – অতি গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক। কেননা, রাজ্যের বকেয়া টাকা কেন্দ্র দীর্ঘদিন ধরে আটকে রেখেছে। রাজ্যের ভাঁড়ার শূন্য। বাংলার উন্নয়নের তহবিল ফাঁকা। যেখানে যতটুকু রাস্তা সারাই কিংবা অন্যকাজ হচ্ছে – সবটাই জোরাতাপ্পি মারা টাকাতে। কেন্দ্রের বেশিরভাগ সামাজিক প্রকল্পই এখন পশ্চিমবঙ্গে বন্ধ। ১০০ দিনের কাজের বকেয়া টাকারও চাপ রয়েছে। এই অবস্থায় কেন্দ্র যদি রাজ্যের বকেয়া টাকা না দেয় – এটা বাংলার প্রতি মোদী সরকারের বঞ্চনা ছাড়া আর কিছুই নয়। এই হল বৈঠকের মোদ্দাকথা। এই কথাগুলো প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে বলতেই বুধবার দিল্লিতে প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনে সাঙ্গ-পাঙ্গদের নিয়ে হাজির হয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
কিন্তু বৈঠকে কী হল?
মজার বিষয় হল মোট ১১জন মিলে প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনে হাজির হলেও মোদী-মমতার বৈঠক হল সাকুল্যে ২০ মিনিটের মতো। অন্তত সংবাদ মাধ্যমের তেমনটাই দাবি। অর্থাৎ এই সময়টা যদি ১১জনকে বলার জন্য নরেন্দ্র মোদী ভাগ করে দিতেন তাহলে প্রত্যেকের ভাগে ২ মিনিটের একটু কম সময় ভাগে পড়ার কথা। অতএব সব সময়টা পুরোপুরি মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ই খরচ করলেন।। তিনিই প্রধানমন্ত্রীকে যা বলার বললেন। কিন্তু কাজের কাজ কিছু হল কী? হল না। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী সবকথা শুনলেন। এবং ২০ মিনিটের বৈঠক শেষে জানিয়ে দিলেন, টাকা এমনি এমনি দেওয়া যাবে না। পশ্চিমবঙ্গের পাওনা-গন্ডার হিসাব করতে একটি কমিটি গড়া হবে। সেই কমিটিতে রাজ্য সরকারেরও আধিকারিকরা থাকবেন। কমিটি পুরো ব্যাপারগুলো খতিয়ে দেখে তবেই বাংলার পাওনা টাকা মেটাবে। তার আগে নয়। বৈঠক এখানেই শেষ।
মিডিয়ায় মমতার বক্তব্য
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর এমন বক্তব্য শোনার পর অনেকেই ভেবেছিলেন মমতা হয়তো মিডিয়ায় নিজের ক্ষোভ উগরে দেবেন। অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ও হয়তো নরেন্দ্র মোদীকে ছেড়ে কথা বলবেন না। কিন্তু বাস্তবে দেখা গেল মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় প্রধানমন্ত্রীর এমন ‘পরামর্শ’ মেনে নিয়েছেন। নিজেই জানালেন, প্রধানমন্ত্রী বাংলার পাওনা-গন্ডার বিষয়টি ঠিক করতে কমিটি গড়ার কথা বলেছেন। কিন্তু সেই কমিটি কেন এতদিনে গড়া হবে, পশ্চিমবঙ্গের ‘হকের টাকা’ পেতে কেনই বা কমিটি লাগবে – সেসব নিয়ে একটি কথাও বললেন না। নিজেই বললেন, ১৫৭টি কেন্দ্রীয় দল এরই মধ্যে রাজ্যে এসে কেন্দ্রীয় প্রকল্পের টাকা নয়-ছয়ের অভিযোগ খতিয়ে দেখেছে। রাজ্য সেই সব কেন্দ্রীয় প্রতিনিধি দলকে না কি পুরোপুরি সাহায্যও করেছে। এরপরেও কেন কমিটি? এনিয়ে এদিন কোনও প্রশ্ন তুলতে দেখা গেল না মমতা কিংবা অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়দের।
তাহলে মোদী-মমতা বৈঠক কীসের জন্য
অনেকের মনেই এই প্রশ্নটা উঠতে পারে, প্রধানমন্ত্রী যখন বাংলাকে টাকাই দেবেন না তাহলে এই বৈঠক কেন? অন্তত মমতা কিংবা অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়রা কোন আশায় প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দরবার করতে গিয়েছিলেন? কেন্দ্র-রাজ্য কমিটি গড়ার পরামর্শ শুনতে? মোটেও না। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নিজেই প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করার সময় চেয়েছিলেন। চেয়েছিলেন রাজ্যের বকেয়া টাকা নিয়ে একটা হেস্ত-নেস্ত করতে। কিন্তু বাস্তবে তেমনটা কিন্তু দেখা গেল না। তবে দিল্লি থেকে ফিরে এরাজ্যের মানুষকে তৃণমূল নেত্রী কিংবা অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়রা বকেয়া টাকা নিয়ে কোন গল্প খাওয়ান সেটা আপাতত বোঝা যাচ্ছে না।
মমতা-মোদী বৈঠকে সৌজন্যবোধ
তবে এটা বেশ বোঝা যাচ্ছে, খালি হাতে প্রধানমন্ত্রীর বৈঠক থেকে ফিরেও মমতা কিংবা অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়রা তেমনটা ক্ষুন্ন নন। তাঁরা যেন আগেই জানতেন মোদীর সঙ্গে বৈঠকের পরেও রাজ্যের টাকা পাওয়া যাবে না। কিন্তু তারপরেও যেভাবে তাঁরা দিল্লিতে ঢোক গিলে চুপ করে রইলেন সেটাকে তৃণমূল নেতারা সৌজন্যবোধের সঙ্গে তুলনা করেছেন। তবে এই সৌজন্যবোধ শুধু মমতা – অভিষেকরা দেখাননি। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীও প্রায় ১ বছর পর মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মুখোমুখি হওয়ার পর তাঁর স্বাস্থ্যের থুড়ি পায়ের খোঁজ-খবর নিয়েছেন। জিজ্ঞেস করেছেন, ‘আপনার পায়ের অবস্থা এখন কেমন?’
মমতার খোঁজ মোদী ঠিকই রাখেন
এই প্রশ্ন থেকেই স্পষ্ট, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সব খবরই নরেন্দ্র মোদী রাখেন। বাংলার তৃণমূল সরকার কখন কী করছে, কোথায় গিয়ে হোঁচট খাচ্ছে, কখন পায়ে ব্যথা হচ্ছে – সব খবরই মোদীর নখদর্পণে। এই পরিস্থিতিতে প্রশ্ন যেটা উঠছে, বকেয়া টাকার জন্য বাংলায় বাঘ আর দিল্লিতে গিয়ে ভিজা বিড়াল সেজে আসলে রাজ্য সরকার আম পাবলিকদের কী বোঝাতে চাইছে? মানুষকে বকেয়া টাকার নামে ক্ষেপিয়ে দিয়ে কিছু লুকোতে চাইছে না তো?
হিসাব দাও টাকা নাও
এদিনের মমতা – মোদী বৈঠকে একটা জিনিস পরিষ্কার, কেন্দ্রীয় সরকার হিসাব ছাড়া টাকা দেবে না। যে হিসাব দিতে লাগাতার গড়ি-মসি করে চলেছে রাজ্য সরকার – সেই হিসাবই মোদীর চায়। তা নাহলে যতই বকেয়া টাকা বকেয়া টাকা করে চেল্লাও – নিট ফল শূন্য। প্রশ্ন হচ্ছে, রাজ্য সরকার এই হিসাব জমা দেওয়ার কাজটা করছে না কেন? কেন্দ্রীয় প্রকল্পের টাকা কোথায় কত খরচ হয়েছে, কোন রাস্তা কতটা তৈরি হয়েছে, কতগুলো শৌচালয় তৈরি হয়েছে, কোথায় কত মাটিকাটা হয়েছে, পুকুর কাটা হয়েছে – এসব তো বাংলার সাধারণ মানুষেরও জানা দরকার। আম পাবলিকও জানতে চায় – এত যখন দুর্নীতির অভিযোগ উঠছে, রাজ্য সরকার হিসাব দিয়ে দুধ কা দুধ পানি কা পানি করে দিক না! তৃণমূলের কর্মী-সমর্থকরাও চাইবেন সব খরচের হিসাব কষে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর মুখে ঝামা ঘষে দিক। আর দিল্লি থেকে বকেয়া টাকা নিয়ে আসুক। কিন্তু মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকারের যত আপত্তি এই হিসেবেই।
বকেয়া টাকার রাজনীতি
সুতরাং বকেয়া টাকা নিয়ে দিল্লির বিরুদ্ধে তৃণমূল সরকারের এই লড়াই যে রাজনীতির ঘুঁটি ছাড়া আর কিছুই নয় সেটাই বার বার স্পষ্ট হচ্ছে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় রাজ্যের মানুষের হকের টাকার কথা বলেন। কেন্দ্র বাংলা থেকে ট্যাক্স তুলে নিয়ে যায় – সেটা বলেন। সেই ট্যাক্স বাংলাকে ফেরত দেয় না – একথাও বলেন। কিন্তু কেন ফেরত দেয় না – এইটা চেপে যান। পাবলিককে শুধু এতটুকু জানান, কেন্দ্র টাকা দিচ্ছে না। মোদী সরকার টাকা দিচ্ছে না। বাংলাকে মোদী ভাতে মারতে চান। কিন্তু কেন্দ্রের টাকা দিয়ে কোথায় কার বাড়ি হল, কার রাস্তা কতটা চওড়া হল – সে সব নিয়ে কোনও কথা বলেন না। এরপরেও বাংলার মানুষ যদি রাজনীতির অঙ্কটা না বোঝেন তাহলে লাখ লাখ কোটি টাকা এই বাংলা দিল্লি থেকে পেলেও বাংলার মানুষের তাতে কোনও লাভ হবে না।
(প্রবন্ধের বক্তব্য একান্তই লেখকের নিজস্ব)