Homeপশ্চিমবঙ্গপশ্চিমবঙ্গে কি রাষ্ট্রপতি শাসন জারি হতে পারে?

পশ্চিমবঙ্গে কি রাষ্ট্রপতি শাসন জারি হতে পারে?

- Advertisement -

কলকাতা: রামনবমীকে কেন্দ্র করে এই মুহূর্তে পশ্চিমবঙ্গের যা পরিস্থিতি তাতে নতুন করে একটি প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে। আর সেই প্রশ্নটা হল, পশ্চিমবঙ্গে কি এবার রাষ্ট্রপতি শাসন জারি হতে পারে?

কথা হল, বাংলায় অনেকবারই ৩৫৬ ধারা জারির দাবি তুলেছে রাজ্য বিজেপি। দলের রাজ্য সভাপতি সুকান্ত মজুমদার থেকে বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী অতীতে বিভিন্ন কারণ দেখিয়ে প্রাক্তন রাজ্যপাল জগদীপ ধনখড়ের কাছে গিয়েছেন। এর আগে তাঁরা এমন আবেদনও করেছেন, ৩৫৬ অনুচ্ছেদ না হলেও নিদেনপক্ষে যেন সংবিধানের ৩৫৫ অনুচ্ছেদ কার্যকর করা হয় বাংলায়।

কিন্তু এ বার আর ৩৫৬ নয়, রাজ্যপাল সিভি আনন্দ বোসের কাছে ৩৫৫ অনুচ্ছেদ জারির আর্জি জানিয়েছেন রাজ্য বিজেপি নেতৃত্ব। অর্থাৎ গোটা রাজ্যে রাষ্ট্রপতি শাসন নয়, সম্প্রতি রামনবমীকে কেন্দ্র করে অশান্ত হয়ে ওঠা হাওড়া জেলার শিবপুর থানা এবং হুগলি জেলার রিষড়া থানা এলাকার আইন-শৃঙ্খলার বিষয়টি অন্তত কেন্দ্র যাতে নিজের হাতে নেয়।

এবং সাংবিধান বিশেষজ্ঞরা বিজেপির এই দাবি নিয়ে বলছেন, এটা সম্ভব। অর্থাৎ কেন্দ্রের নরেন্দ্র মোদী সরকার যদি মনে করে তাহলে হাওড়া ও হুগলি জেলার নির্দিষ্ট কয়েকটি এলাকায় আংশিক রাষ্ট্রপতি শাসন (৩৫৫ ধারা) জারি করতে পারে।

সংবিধানের ৩৫৬ ও ৩৫৫ ধারার মধ্যে ফারাক

পরিস্কার কথায়, সংবিধানের ৩৫৬ অনুচ্ছেদ (যা জনপ্রিয় ধারণায় ‘৩৫৬ ধারা’ বলে প্রচলিত) হল রাষ্ট্রপতি শাসন। কেন্দ্র সরকার যদি মনে করে কোনও রাজ্য সংবিধান মেনে কাজ করছে না তাহলে সেই রাজ্যের ক্ষমতা সংবিধানের ৩৫৬ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী নিজের হাতে নিতে পারে।

কিন্তু সংবিধানের ৩৫৫ অনুচ্ছেদ বলছে, যদি কোনও রাজ্য বহিরাগত শত্রু কিংবা অভ্যান্তরীন গণ্ডগোলের মুখে পড়ে মুশকিলে পড়ে তাহলে কেন্দ্র সরকারকে সাহায্য করতে হবে। অর্থাৎ এক্ষেত্রে কেন্দ্র সরকার নিজের হাতে কোনও রাজ্যের ক্ষমতা নেবে ঠিকই কিন্তু সেটা হবে রক্ষা করার জন্যে।

সাধারণভাবে এই দুই অনুচ্ছেদকে একই মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ বলে মনে হতে পারে। আর এই কারণেই সংবিধানের ৩৫৬ অনুচ্ছেদকে অনেক বিশেষজ্ঞ কেন্দ্রের অস্ত্র এবং ৩৫৫ অনুচ্ছেদকে ঢাল হিসেবে বর্ণনা করেন।

পশ্চিমবঙ্গে কি ৩৫৫ ধারা জারির পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে?

বিরোধীদল বিজেপি অন্তত মনে করে, পশ্চিমবঙ্গে সেই রকমই একটা পরিবেশ তৈরি হয়েছে। রাজ্যের বিরোধীদলনেতা শুভেন্দু অধিকারীর মতে, এই মুহূর্তে পশ্চিমবঙ্গের কোনও মানুষই নিরাপদ নন। তৃণমূল সরকার মানুষের অধিকার থেকে শুরু করে আইন-শৃঙ্খলা সবকিছুতেই আগুন নিয়ে খেলা শুরু করেছে।

এই মুহূর্তে পশ্চিমবঙ্গে একদিকে একের পর এক দুর্নীতির জেরে মানুষের মৌলিক অধিকারকে নিয়ে যেমন ছেলে-খেলা হচ্ছে, অন্যদিকে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি একেবারে ভেঙে পড়ছে। মোদ্দা কথায়, পশ্চিমবঙ্গে এখন আইনের শাসন নয় শাসকের আইন চলছে।

তাছাড়া, যেভাবে এনআইএ বা জাতীয় তদন্তকারী সংস্থা পশ্চিমবঙ্গ থেকে একের পর এক জিলেটিন স্টিক ও অ্যামোনিয়াম নাইট্রেট উদ্ধার করে চলেছে তাতে ভারতের বিরুদ্ধে গুরুতর ষড়যন্ত্রের গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে।

রানিগঞ্জ, রাজারহাট ও মঙ্গলপুরের মতো এলাকা থেকে ইতিমধ্যেই উদ্ধার হয়েছে ৮১ হাজার জিলেটিন স্টিক আর ২৭ হাজার কেজি অ্য়ামোনিয়াম নাইট্রেট। বিশেষজ্ঞদের মতে, এই পরিমাণ বিস্ফোরক কলকাতার মতো শহরে মুম্বই হামলার মতো ৮ থেকে ১০ হাজার বিস্ফোরণ ঘটাতে পারত।

মোদী সরকার কি শুভেন্দুদের দাবি মানবে?

কিন্তু লাখ টাকার যেটা প্রশ্ন হল, রাজ্য বিজেপির সভাপতি সুকান্ত মজুমদার কিংবা রাজ্যের বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারীর দাবি কি কেন্দ্রের নরেন্দ্র মোদী সরকার মানবে? এতদিন যে দাবি নিয়ে কেন্দ্রকে নড়চড় করতে দেখা যায় নি, সেই দাবিকে এবারও যে কেন্দ্র উড়িয়ে দেবে না তার গ্যারান্টি কি আছে?

আসলে রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, কেন্দ্রের নরেন্দ্র মোদী সরকার কংগ্রেসের মতো নিজেদের গায়ে কলঙ্ক মাখতে চাইছে না। বিজেপি নীতিগত ভাবে ৩৫৬ ধারা জারির বিপক্ষে। আর সেই কারণেই হয়ত এখনও পর্যন্ত কোনও রাজ্যে ৩৫৬ ধারা জারি করেননি কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ।

আজ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকারের বিরুদ্ধে যতবড়ই দুর্নীতির অভিযোগ উঠুক না কেন, হাজার হোক তৃণমূল তো পশ্চিমবঙ্গের মানুষের ভোটেই জিতে এসেছে। গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে জয়ী হয়ে তৃতীয়বার বাংলার ক্ষমতা দখল করেছে।

সুতরাং যে ভারত সরকার সারাবিশ্বে নিজেকে পৃথিবীর সবথেকে বড় গণতান্ত্রিক দেশ বলে তুলে ধরে বিশ্ববাসীর বাহবা কুড়োনোর চেষ্টা করছে সেখানে একটি গণতান্ত্রিক সরকারকে ফেলে দিয়ে রাষ্ট্রপতি শাসন জারি করলে হিতে বিপরীত হতে পারে।

আর যে মোদী সরকারের বিরুদ্ধে ইডি-সিবিআইয়ের ব্যবহার করে বিরোধীদের কোনঠাসা করে দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে, যে মোদী সরকারের বিরুদ্ধে রাহুল গান্ধীর সাংসদ পদ খেয়ে নেওয়ার অভিযোগ তোলা হচ্ছে, এবার যদি সেই মোদী সরকার মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকারকে ফেলে দিয়ে রাষ্ট্রপতি শাসন জারি করে তাহলে মোদী সমালোচকেরা কিন্তু হাতে বড় হাতিয়ার পেয়ে যাবে।

এতে বিজেপি-আরএসএস বদনাম তো হবেই কিন্তু একই সঙ্গে বিশ্বের দরবারে ভারত ও ভারতের গণতন্ত্রও বদনাম হবে। এমনিতেই ভারতের আর্থিক উন্নতিতে ব্রিটেনের মতো বিশ্বের বহুদেশের চোখ টাটিয়ে রয়েছে। তারপরে যদি পশ্চিমবঙ্গে রাষ্ট্রপতি শাসন জারি হয় তাহলে বিবিসির মতো আন্তর্জাতিক সংবাদ সংস্থা কিন্তু মোদী সরকারকে ছেড়ে কথা বলবে না।

তাহলে সুকান্ত-শুভেন্দুদের দাবির কি হবে?

রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, পশ্চিমবঙ্গে ৩৫৬ ধারা প্রয়োগ যে সম্ভব নয়, সেটা সুকান্ত-শুভেন্দুরা ভালোই বোঝেন। আর সেই কারণেই তাঁরা ৩৫৬র বদলে ৩৫৫ ধারার কথা বলছেন। সোজা থাপ্পড় মারার বদলে ঘুরিয়ে কান ধরার কথা বলছেন।

বিজেপি নেতারা জেনে বুঝেই সংবিধানের ৩৫৫ নম্বর অনুচ্ছেদের দাবি জানাচ্ছেন। সারা পশ্চিমবঙ্গে রাষ্ট্রপতি শাসন জারির পরিবর্তে বিজেপির নেতারা আপাতত রাজ্যের দু’টি এলাকাকে ‘উপদ্রুত’ অঞ্চল বলে মনে করছেন। সেই দুই এলাকায় সংবিধানের ৩৫৫ অনুচ্ছেদ জারির জন্য কেন্দ্রকে যাতে রাজ্যপাল চিঠি পাঠান, সেই দাবিই জোরালো ভাবে পেশ করেছেন রাজ্য বিজেপি নেতৃত্ব। 

কিন্তু রাজ্য বিজেপি নেতাদের এই দাবিও কতটা পূরণ হবে তা নির্ভর করছে রাজ্যপাল সি ভি আনন্দ বোসের কেন্দ্রকে দেওয়া রিপোর্টের ওপর। এবং সেই রিপোর্ট কতটা ‘কড়া’ হবে সেটা আবার নির্ভর করছে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহর মন্ত্রকের ইচ্ছের ওপর।

এমনিতে নবান্নর কাছে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রক রামনবমীতে পশ্চিমবঙ্গের দুই জেলার হিংসার বিষয়টি নিয়ে বেশ কয়েক দফায় রিপোর্ট চেয়ে পাঠিয়েছে। রাজ্যপাল সিভি আনন্দ বোসও নিশ্চয় রিপোর্ট পাঠাবেন। কিন্তু রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, নবান্ন কি লিখে পাঠায় তার ওপর রাজ্যপালের রিপোর্টের সুর নির্ভর করবে।

বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারীর ‘চাপের’ পরেও সেই কারণেই হয়তো রাজ্যপাল সিভি আনন্দ বোস মিডিয়াকে আপাতত এটুকুই বলেছেন, ‘‘এটা তো একটা দাবি। বিরোধী দলনেতার এই ধরনের দাবি করার অধিকার আছে। বিরোধীদের কাজই হল বিরোধিতা করা। তাই বিরোধী দলনেতা কিছু দাবি করছেন, এটা গণতন্ত্রে খুব স্বাভাবিক। রাজ্যপাল হিসাবে আমি সংবিধানের পথেই হাঁটব।’’

- Advertisement -
- Advertisement -
- Advertisement -
- Advertisement -