Homeরাজনীতিদিদি, মিথ্যাশ্রী পদকটা কিন্তু ফের ফসকে গেল

দিদি, মিথ্যাশ্রী পদকটা কিন্তু ফের ফসকে গেল

- Advertisement -

অরণ্য রায়

আমাদের দিদি মানে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো করেই আমিও বলি, আমিও ঠিক করেছিলাম – বালেশ্বরের ট্রেন দুর্ঘটনাতে রাজনীতির কথা বলব না। তাই এনিয়ে কোনও ভিডিও পারফেক্ট পলিটিক্স বানায়নি। কিন্তু রবিবার যখন খোদ মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এনিয়ে রাজনীতি না করার কথা বলেও রাজনীতি করতে শুরু করলেন, স্বাভাবিক ভাবেই আমাদেরও মনে হল – এবার বালেশ্বর ট্রেন দুর্ঘটনা নিয়ে রাজনীতির কথা বলা যেতেই পারে। সুতরাং শুরু করা যাক।

মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কতটা কাজ করেন সেটা বোঝানোর জন্য রবিবার ছুটির দিনে সাংবাদিক বৈঠক করলেন। সাংবাদিকদের সঙ্গে সোমবার কথা বললেও চলত। কিন্তু তিনি রবিবারই বালেশ্বরের রেল দুর্ঘটনা নিয়ে রাজনীতি শুরু করলেন। আসলে অনেকেই যেটা বলেন, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় চুপচাপ কোনও কাজই করতে পারেন না। কাজ যাই হোক না কেন, যতটুকুই হোক না কেন – ঢাক ঢোল পেটানো চায়। ঢাক ঢোল পিটিয়ে লোককে বলা চায় – দেখ আমি কেমন কাজ করছি। ছুটির দিনেও অফিসে ওভারটাইম করছি। মানে নবান্নে বসে বালেশ্বরের রেল দুর্ঘটনাগ্রস্তদের খোঁজ খবর থেকে শুরু করে ব্যবস্থাপনা করছি। যেহেতু একটা দিন হাঁড়ির হাল বুঝতে একটু সময় লেগেছিল, তাই নিহতদের পরিবারের জন্য ৫ লাখ টাকা করে দেওয়ার ঘোষণাটা রবিবার ছুটির দিনে করছি।

এতদূর পর্যন্ত না হয় সবই ঠিক ছিল। মুখ্যমন্ত্রী রবিবার কাজ করছেন, নিহতদের আর্থিক ক্ষতিপূরণ দিচ্ছেন – দরদি আর কাজের সরকার হলে এসব করতেই হয়। কিন্তু ওই যে, কাজ করব কিন্তু লাভের গুড়টা খাব না – এই ভুলটা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর রাজনৈতিক দীর্ঘ জীবনে কখনও করেন নি। এদিনও করলেন না। এই সময় ভুল না করাই উচিত। আর যাই হোক এই বালেশ্বরের রেল দুর্ঘটনা বাঙালি পাবলিকের দুটোদিন খবরের রুচি বদল করেছে। ওই নিয়োগ দুর্নীতি, ওই বকেয়া ডিএ, ওই অভিষেকের নবজোয়ারে তৃণমূলের গোষ্ঠীকোন্দল, ওই পার্থ, কুন্তল, কেস্ট আর কালীঘাটের কাকু – রোজ একই খবর যেন বাঙালি দর্শকদের কাছে ভাঙা রেকর্ড হয়ে গিয়েছিল। অনেকেই নিশ্চয় এক ঘেয়েমি বোধ করছিলেন। সুতরাং বালেশ্বরের দুর্ঘটনা যতই শোকের হোক না কেন – দুর্নীতি আর কালীঘাটের কাকুর খবর থেকে বাঙালি দর্শকরা দুটো দিন অন্তত রক্ষা পেয়েছে।

কিন্তু শুধু বাঙালি দর্শকের কথা বলি কেন? মুখে স্বীকার করুক বা না করুক, আরও কিছু লোক এতে দিন কয়েকের জন্য হলেও শান্তি পেয়েছে। শুধু শান্তি পেয়েছে বললে ভুল হবে, কেন্দ্রের নরেন্দ্র মোদী সরকার এবং বিজেপিকে পালটা আক্রমণের একটা বড় সুযোগ হাতে পেয়েছে। অনেকে তো আবার এটাও বলছেন, বালেশ্বরের দুর্ঘটনা কিছু মানুষের কাছে এতটাই লোভের বস্তু হয়ে উঠেছিল যে নিজেকে নাকি ধরে রাখতে পারেননি। ওড়িশার মুখ্যমন্ত্রী নবীন পট্টনায়ক ঘটনাস্থলে পৌঁছোনোর আগেই নাকি হেলিকপ্টার নিয়ে বালেশ্বরের দুর্ঘটনা স্থলে পৌঁছে গিয়েছিলেন। এবং পৌঁছে গিয়ে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে কী বুঝেছিলেন কে জানে, কিন্তু মিডিয়ার সামনে বাইট দিয়ে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন, পুরনো রেলমন্ত্রী হিসেবে রেল সম্পর্কে তাঁর অনেক অভিজ্ঞতা আছে। এবং জ্ঞাণেশ্বরীর রেল দুর্ঘটনা কিংবা সাম্প্রতিক বগটুইয়ের পুড়িয়ে মারার মতো ঘটনার মতো করেই মাটিতে পা দিয়েই বুঝে ফেলেছিলেন ঠিক কী ঘটেছে। কে ঘটিয়েছে। কিভাবে ঘটিয়েছে। ওসব তদন্ত-ফদন্তে কী বেরোবে তিনি আগে থেকেই জানেন। এবং যথারীতি কেন্দ্রের নরেন্দ্র মোদীকে সরকারকে বালেশ্বরের মাটিতে দাঁড়িয়েই খোঁচাটা দিয়েছিলেন।

ব্যস আর যায় কোথায়! উল্টোপক্ষ তো আর দুর্বল নয়, সুতরাং রাজনীতির পালটা খোঁচাটাও এল ১০ গুণ বেশি হয়ে। সাল তারিখ ধরে ধরে অপরপক্ষ বুঝিয়ে দিল, রেলমন্ত্রী হিসেবে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় রেলদুর্ঘটনা রুখতে কতটা সফল হয়েছিলেন। এবং তাঁর আমলে কতগুলো দুর্ঘটনা হয়েছিল, মোট কত যাত্রী প্রাণ হারিয়েছিল – ইত্যাদি ইত্যাদি। আর পড়বি তো পড় সেই তথ্য পড়েছে একেবারে এগিয়ে বাংলার মুখ্যমন্ত্রীর চোখে। সুতরাং এবার দেখ রাজনীতির খেলা কাকে বলে!

সেই রাজনীতির খেলা দেখাতেই মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় রবিবারের সাংবাদিক বৈঠক শুরু করলেন এই বলে যে তিনি বালেশ্বরের রেল দুর্ঘটনা নিয়ে রাজনীতি করতে চাননি। আমার বিশ্বাস একথা কেউ বিশ্বাস করেননি। হয়তো মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও সে কথা জানতেন। সুতরাং রবিবার তিনি বললেন, কিন্তু তাঁকে বাধ্য করানো হয়েছে রেল দুর্ঘটনা নিয়ে রাজনীতির কথা বলতে। মানে ওই যে রেলমন্ত্রী মমতার সব ইতিহাস সোশাল মিডিয়ায় দিয়ে দেওয়া হয়েছে – সুতরাং তিনি সেটা সইবেন কেমন করে! হাজার হোক তাঁর বিরুদ্ধে না কি মিথ্যা তথ্য দেওয়া হয়েছে। মিথ্যা অপবাদ ছড়ানো হয়েছে। সুতরাং তিনিও পালটা সাংবাদিক বৈঠক করলেন। বৈঠকে গুগলের উইকিপিডিয়া থেকে তথ্য তুলে ধরে জানালেন, রেলমন্ত্রী হিসেবে তাঁর আমলে মোটে ৩টি রেল দুর্ঘটনা হয়েছে। অথচ, কেন্দ্র সরকার মানে নরেন্দ্র মোদীর সরকার বলছে, রেলমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আমলে কয়েক হাজার যাত্রী রেল দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছে। বালেশ্বর নিয়ে রাজনীতি করতেই এসব বলা হচ্ছে। তাই পালটা তিনিও নবান্নে এবার পালটা রাজনীতি করতে নামলেন। এরপর মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বালেশ্বর রেল দুর্ঘটনা নিয়ে রাজনীতি করছেন বলে দোষ দিলে চলবে না।

কিন্তু এগিয়ে বাংলার মুখ্যমন্ত্রী এখানেই থামলেন না। তিনি বিশ্বাস করেন, এতদিন যা যা দায়িত্বই তিনি পেয়েছেন বা নিয়েছেন – সবেতেই নাম্বার ওয়ান থেকেছেন। এখন যেমন বাংলার মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে সারা দেশে থুরি সারা বিশ্বে উন্নয়নের নিরিখে বাংলাকে একে এগিয়ে নাম্বার ওয়ান করে দিয়েছেন, ঠিক তেমনই ২০০৯ সালে তিনি যখন রেলমন্ত্রীর দায়িত্ব নেন – তখনও এক ঝটকায় ভারতীয় রেলকে এতটাই এগিয়ে দিয়েছিলেন যে বালেশ্বরের মতো নাকি দুর্ঘটনা ঘটায় সম্ভব ছিল না। কিন্তু কেন্দ্রের নরেন্দ্র মোদীর মাথামোটা সরকার সব শেষ করে ফেলেছে। রেলভবন ও রেল বাজেট সব লাটে তুলে দিয়েছে। শুধু ভারতীয় রেলকে বেসরকারি হাতে বিক্রি করার জন্য রেখে দিয়েছে।

আর ভারতের প্রাক্তন রেলমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের এমন বক্তব্যের পরেই অনেকে যেটা বলছেন, যে আরও একবার মিথ্যাশ্রী পদকটা আমাদের মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের হাত থেকে ফসকে গেল। অনেকেই বলবেন, বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী তো উলটো বলেন। তিনি তো মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে মিথ্যাশ্রী পুরস্কার দেবেন বলে ঠিক করে ফেলেছেন। কিন্তু না বন্ধুরা, শুভেন্দু অধিকারী ঠিক কথা বলছেন না। কেন না, অনেকের মতে, আমাদের মুখ্যমন্ত্রী মিথ্যা কথাটাও ঠিকঠাক বলতে পারেন না। ব্যাপারটা এই রকম –

বালেশ্বরের রেল দুর্ঘটনা নিয়ে বলতে গিয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ৪টি রেল দুর্ঘটনার কথা বলেছেন। ১। ২০০৯ সালের ২০ অক্টোবর মথুরায় গোয়া এক্সপ্রেস এবং মেওয়ার এক্সপ্রেসের দুর্ঘটনা। এই দুর্ঘটনায় ২১ জন যাত্রী প্রাণ হারিয়েছিলেন। ২। ২০১০ সালের ২ জানুয়ারিতে গোরখধাম ও প্রয়াগরাজ এক্সপ্রেসের দুর্ঘটনা। এই দুর্ঘটনায় ১০ জন যাত্রী প্রাণ হারিয়েছিল। ৩। ওই বছরেরই ২৮ মে জ্ঞাণেশ্বরী এক্সপ্রেসের দুর্ঘটনা। এই ঘটনায় ১৪০ জন যাত্রীর প্রাণ গিয়েছিল। কিন্তু মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দাবি মতো – এই দুর্ঘটনা মাওবাদীরা ঘটিয়েছিল। সুতরাং এর দায় রেলমন্ত্রী হিসেবে তাঁর ঘাড়ে চাপানো যায় না। এবং ৪ নম্বর দুর্ঘটনাটি ঘটেছিল সাঁইথিয়ায়। ২০১০ সালের ১৯ জুলাই উত্তরবঙ্গ এক্সপ্রেস এবং বনানঞ্চল এক্সপ্রেসের মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়েছিল। ওই ঘটনায় মারা গিয়েছিল ৬৬ জন যাত্রী। ব্যস! আর তেমন দুর্ঘটনা নেই। বরং তিনি রেলের সিগন্যালিং সিস্টেম নাকি এতটাই উন্নত করে দিয়েছিলেন যে বালেশ্বরের মতো দুর্ঘটনা হওয়া অসম্ভব ব্যাপার ছিল। তাছাড়া, আনম্যানড লেভেল ক্রসিং বন্ধ করেছিলেন। রেলের যে রক্ষাকবচ নিয়ে এত কথা হচ্ছে, সেই রক্ষাকবচের ব্যবহার নাকি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় রেলমন্ত্রী থাকার সময়ই শুরু করেছিলেন। এবং রেল দুর্ঘটনা অনেক কমে গিয়েছিল। এবং এই যে এতদিন পর বালেশ্বরের মতো দুর্ঘটনা ঘটল – সেটা তাঁর সেই রক্ষাকবচ লাগানো, সিগন্যালিং সিস্টেম আপডেট আর আনম্যানড লেভেল ক্রসিং বন্ধ করার ফলেই হয়েছে। কিন্তু তারপরেও যেহেতু এতবড় ঘটনা ঘটেছে – এর পিছনে মোদী সরকারের দায় আছে।

আর এখানেই প্রশ্ন উঠছে, দিদি যদি ভারতীয় রেলে এত ব্যবস্থা করেই থাকেন তাহলে বালেশ্বরের দুর্ঘটনা ঘটল কী করে? রেলকে যদি তিনি এগিয়ে বাংলার মতোই এগিয়ে দিয়ে থাকেন – তাহলে ভারতীয় রেল ফের পিছিয়ে গেল কী করে? মোদী সরকার কী ফের পুরনো সিগন্যালিং সিস্টেম ব্যবহার করছে, রক্ষাকবচ খুলে নিয়েছে? নাকি আনম্যানড লেভেল ক্রসিং ফের আনম্যানড করে দিয়েছে? এখানেই আসল কথার খেলাটা খেলেছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। মহাভারতের মতো করেই বলতে হয়, তিনি অশ্বত্থমা হত – ইতি গজ বলে বাংলার পাবলিককে তাতানোর চেষ্টা করেছেন। কেননা, যে সময় তিনি রেলমন্ত্রী ছিলেন, সেই সময় আপনাদের বন্ধু, ভাই এই অধম, মানে আমি দিল্লিতে রেলবিট কভার করতাম। সুতরাং মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় রেলমন্ত্রী হিসেবে কী করেছিলেন আর এখন বলছেন – দুয়ের ফারাকটা ভালোমতই আমার জানা।

প্রথমেই বলে নেওয়া যাক, দুর্ঘটনার কথা। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন – তাঁর রেলভবনে থাকার সময় নাকি চারটিই বড় রেল দুর্ঘটনা ঘটেছিল। যেখানে ১০ জনের বেশি যাত্রী মারা গিয়েছিলেন। কিন্তু ১৯৯৯ সাল থেকে ২০০১ পর্যন্ত বিজেপির নেতৃত্বাধীন এনডিএ সরকারে যে তিনি রেলমন্ত্রী ছিলেন সেটা কী তিনি ভুলে গিয়েছেন? আর সেই সময়ে যে তাঁর রেলমন্ত্রী থাকাকালীন হাওড়া-অমৃতসর মেলের এক্সিডেন্টে কমপক্ষে ৪৫ জন যাত্রী মারা গিয়েছিলেন সে হিসেব কে দেবে? এছাড়াও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের এনডিএ ও ইউপিএ আমলের রেলমন্ত্রীত্ব মিলিয়ে আরো প্রায় ডজন তিনেক রেল দুর্ঘটনা ঘটেছিল। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আরও যে কথাটা বেমালুম ভুলে গেলেন সেটা হল – তাঁর আমলেই রেলদুর্ঘটনা হ্যাট্রিক করেছিল। মানে পরপর ৩দিন ৩টি রেল দুর্ঘটনা ঘটেছিল। তাঁর আমলেই রাজধানীর মতো ট্রেন বেশ কয়েকবার বড়সর দুর্ঘটনার হাত থেকে অল্পের জন্য রক্ষা পেয়েছিল। তাছাড়া, তাঁর আমলে রেল দুর্ঘটনা এতটাই ঘন ঘন হতো যে ছোটো দুর্ঘটনাকে গুণতির মধ্যে ধরা হতো না।

কিন্তু মজার কথা হল, যখন তিনি বিধানসভা ভোটে জিতে বাংলার মুখ্যমন্ত্রী হলেন – সেই সময় প্রায় মাস দুয়েক ভারতীয় রেলকে মন্ত্রী বিহীন করে রেখেছিলেন। কেননা, তিনি তো বাংলার মুখ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব নিলেন, কিন্তু রেলমন্ত্রক কার হাতে দেবেন সেটা ঠিক করতে পারছিলেন না। বিশ্বাসযোগ্য ব্যক্তি খুঁজে পাচ্ছিলেন না। পরে মুকুল রায়ের মতো বিশ্বাসভাজন, ডান হাত বলে পরিচিত নেতাকে হাতে গোল্লা ধরিয়ে দীনেশ ত্রিবেদিকে রেলমন্ত্রী করেন। ভাববেন না এটা ছোট ঘটনা ছিল। কারণ, দীনেশ ত্রিবেদীর হাতে রেলমন্ত্রক ছাড়ার ঠিক একদিন আগে বড় একটা রেল দুর্ঘটনা ঘটেছিল। সবাই সমালোচনা শুরু করেছিল মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নিজের কোটায় কাউকে রেলমন্ত্রী করছিলেন না বলে। এটা ইউপিএ টু সরকারের শুরুর কথা। সিপিএম ইউপিএ সরকার থেকে সমর্থন তুলে নেওয়ায় মমতা ওই ফাঁকে ইউপিএতে নিজেকে গুঁজে দেন। এবং কংগ্রেস ও মনমোহনকে সমর্থনের শর্ত হিসেবে রেলমন্ত্রক হাতে পান। এবং বাংলার মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পরেও তিনি রেলমন্ত্রক নিজের হাতে রাখতে চেয়েছিলেন। কেননা, রেলমন্ত্রী হিসেবে মমতা বাংলার জন্য প্রচুর রেল প্রকল্পের ঘোষণা করেছিলেন। যার কাজের জন্য টাকার প্রয়োজন ছিল। কিন্তু কাকে দায়িত্ব দেবেন, কে তাঁর ইচ্ছামতো রেলমন্ত্রকে কাজ করবে বুঝে উঠতে পারছিলেন না। এই ফাঁকেই ৭ জুলাই মথুরা – ছাপড়া এক্সপ্রেস উত্তরপ্রদেশের কাশীরাম নগরের একটি লেভেল ক্রশিংয়ে যাত্রীবোঝাই বাসকে ধাক্কা মারায় ৩৮ জনের মৃত্যু হয়।

ঠিক তার ৩ দিনের মাথায় কানপুরের কাছে ফতেহপুরে ঠিক বালেশ্বরের মতোই বড়সর রেল দুর্ঘটনা ঘটে। ফতেহপুর স্টেশনের লুপ লাইনে মালগাড়ি দাঁড়িয়েছিল। আর যে ট্রেনটি দুর্ঘটনার কবলে পড়েছিল সেটিও ছিল এই পশ্চিমবঙ্গের। নাম হল কালকা মেল। ২০১১ সালের ১০ জুলাই কালকা মেল উত্তরপ্রদেশের ফতেহপুরে ডিরেইল হয়ে বালেশ্বরের কায়দাতেই উলটে যায়। প্রাণ হারান কমপক্ষে ৭০ জন যাত্রী। এই যাত্রীদের বেশিরভাগই ছিল বাঙালি। এই দুর্ঘটনার পরদিনই আচমকা দীনেশ ত্রিবেদীকে রেলমন্ত্রীর চেয়ারে বসান মমতা। আর দীনেশ ত্রিবেদী রেলমন্ত্রীর দায়িত্ব নিয়েই ছুটে গিয়েছিলেন ঘটনাস্থলে। সঙ্গে আমাদের মতো সাংবাদিকরাও। সেদিন কিন্তু দীনেশ ত্রিবেদী আজকের রেলমন্ত্রী অশ্বিনী বৈষ্ণবের মতো ঘটনাস্থলে দাঁড়িয়ে সারাক্ষণ উদ্ধারকাজের তদারকি করেন নি। তিনি সেদিন রাতেই ফতেহপুর থেকে দিল্লি ফিরে এসেছিলেন।

কিন্তু প্রশ্ন সেটা নয়। প্রশ্ন হচ্ছে, এই যে কালকা মেলের দুর্ঘটনা এটা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর সময়ের রেল দুর্ঘটনা বলে স্বীকার করেননি বা করতে চাননি। হতে পারে দীনেশ ত্রিবেদী এখন বিজেপিতে বলে। কিন্তু এটা তিনি অস্বীকার করবেন কী করে যে তাঁর আমলে রেলে অত্যাধুনিক সিগন্যালিং ব্যবস্থা, এসিডি বা রক্ষাকবচ কিংবা আনম্যানড লেভেল ক্রসিং বন্ধ করে দেওয়ার পরেও এই দুর্ঘটনাগুলি কী করে ঘটেছিল? এখানেই শেষ নয়, দীনেশ ত্রিবেদীর রেলমন্ত্রী হিসেবে এক বছর বয়স হতে না হতেই আচমকাই মুকুল রায়কে নতুন রেলমন্ত্রীর দায়িত্ব দেন মমতা। আর তাঁর দায়িত্ব নেওয়ার পরেও একের পর এক রেল দুর্ঘটনা ঘটতে থাকে। এরমধ্যে উল্লেখ করার মতো ঘটনা হল অন্ধ্রপ্রদেশের হাম্পি এক্সপ্রেসের দুর্ঘটনা। এতে ১৪ জন যাত্রী মারা গিয়েছিলেন। তারপর হাওড়া দুন এক্সপ্রেসের দুর্ঘটনা। এতে কমপক্ষে ৭ জন যাত্রী মারা গিয়েছিলেন। তামিলনাডু এক্সপ্রেসের দুর্ঘটনা। কমপক্ষে ৪৭ জন মারা গিয়েছিলেন। মমতার এগিয়ে ভারতীয় রেলে এই ঘটনাগুলো কী করে ঘটেছিল? কেন ঘটেছিল?

আসলে এর উত্তর হল, যে রক্ষাকবচের ব্যবহার নিয়ে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এখন প্রশ্ন তুলছেন, সেই রক্ষাকবচ তখনও রেল ব্যবহার করতে শুরুই করেনি। কোঙ্কন রেলে ট্রায়াল শুরু হয়েছিল মাত্র। দ্বিতীয় সত্যি ঘটনা হল, রেলমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আমলে রেলের লাগাতার দুর্ঘটনার পর রেলের তদন্তে উঠে এসেছিল, ভারতীয় রেলের সিগন্যালিং ব্যবস্থা পুরাতন, তাই বারবার দুর্ঘটনা ঘটছে। সুতরাং এই সিগন্যালিং ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন করতে হবে। কিন্তু মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সেই সিগন্যালিং ব্যবস্থার পরিবর্তন করার সাহস পাননি। কারণ, রেলের কমিটি তার রিপোর্টে বলেছিল, এরজন্য কম করে দেড়লক্ষ কোটি টাকা লাগবে। টাকা কে দেবে? তখন গোটা রেলেরই বাজেট ৪০ হাজার কোটি টাকার মতো। সুতরাং দেড়লক্ষ কোটি টাকা মনমোহনের মতো প্রধানমন্ত্রী যে দেবেন না সেটা মমতা ভালোই বুঝেছিলেন।

আর সবশেষে আসি লেভেল ক্রসিং নিয়ে। এখানেও খেলা আছে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সত্যি সত্যিই রেলমন্ত্রী হিসেবে রেলের যত লোকবিহীন লেভেল ক্রসিং ছিল সেগুলিতে লোক নিয়োগের জন্য উঠে-পড়ে লেগেছিলেন। বিশেষ করে আমাদের বাংলায় সেই সময় নাকি পাইকারি হারে রেলের এই লেভেল ক্রসিংয়ে লোকে চাকরি দেওয়া হচ্ছিল। অনেকটা মালদার গণি খানের কায়দায়। অনেকে ভাববেন, রেলমন্ত্রী হিসেবে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় গণি খানকেও টেক্কা দিতে চেয়েছিলেন। মোটেও না, সেই সময় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বিধানসভা ভোটের প্রস্তুতি সারছিলেন। এবং লোকে বলে, রেলমন্ত্রী হিসেবে লেভেল ক্রসিংয়ের চাকরি বিলোচ্ছিলেন। বিজেপি নেতারা তো এমনটাও দাবি করেন যে আসলে সেই সময় থেকেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নিয়োগে দুর্নীতি শুরু করে দিয়েছিলেন। সুতরাং আজকের যে নিয়োগ দুর্নীতি বাংলার মানুষ দেখছে তার শুরু বলতে গেলে রেলমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সময় থেকেই – এটাই বিরোধীদল বিজেপির দাবি।

তবে বিজেপির দাবি সত্যি না মিথ্যা আপনারাই বলবেন। কিন্তু মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় রেলমন্ত্রী হিসেবে যে সফলতার কথা রবিবার বললেন সেটা যে আসলে অর্ধসত্য সেটা বেশ বুঝতেই পারছেন। সুতরাং শুভেন্দু অধিকারী যতই বলুন না কেন, তিনি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে কথায় কথায় মিথ্যা কথা বলার জন্য মিথ্যাশ্রী উপাধি দেবেন – আমরা বলব, সেটা মোটেও ঠিক নয়। কেননা, মিথ্যাটাও তিনি ঠিকঠাক মতো বলেন না।

- Advertisement -
- Advertisement -
- Advertisement -
- Advertisement -