অরণ্য রায়
দু’দিন আগেই রাজ্যের শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসু এবং তৃণমূলের মুখপাত্র কুণাল ঘোষের সঙ্গে বৈঠক করেছিলেন চাকরিপ্রার্থীরা। তাতে একটা বিতর্ক তৈরি হয়েছিল – নিয়োগ জট কাটানোর তারিখ নিয়ে। চাকরিপ্রার্থীদের প্রতিনিধিরা বৈঠকের পর বাইরে বেরিয়ে এসে দাবি করেছিলেন, ১ ফ্রেব্রুয়ারির মধ্যেই না কি তাঁরা নিয়োগপত্র পেতে শুরু করবেন। এবং এতদিন রোদ-জল-বৃষ্টিতে পড়ে থেকে আন্দোলন করার পর মিস্টি ও সুখবর নিয়ে বাড়ি ফিরবেন।
কিন্তু সেই বেঠকের পরেই শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসু বাইরে সংবাদ মাধ্যমের সামনে বলেছিলেন, চাকরির নিয়োগপত্র কবে দেওয়া হবে তার কোনও নির্দিষ্ট দিনক্ষণ তিনি কাউকে জানান নি। এ ব্যাপারে কাউকে কোনও কথাও দেননি। এরপরই প্রশ্ন উঠেছিল, বৈঠকে আদৌ হল টা কী? কিন্তু দু‘দিন কাটতে না কাটতেই দেখা গেল, চাকরির নিয়োগপত্র কবে পাওয়া যাবে কিংবা দেওয়া হবে সেটা কোনও বিষয় নয়, বরং আইনজীবী তথা সিপিএম নেতা বিকাশরঞ্জন ভট্টাচার্য চাকরিপ্রার্থীদের কাছ থেকে মামলা করার জন্য কতটাকা খেয়েছেন – সেটাই হল মোদ্দা বিষয়।
বিকাশরঞ্জন ভট্টাচার্যকে নিয়ে এই বিতর্ক কি আচমকাই প্রকাশ্যে এল? এতদিন তো তিনি চাকরিপ্রার্থীদের হয়ে নানান মামলা লড়েছেন – সেই টাকা টাকা নিয়ে না কি বিনা পয়সায় সেটা নিয়ে এতদিন কেউ বিতর্ক তৈরি করেননি। কিন্তু কাকতালীয়ভাবে ব্রাত্য বসু আর কুণাল ঘোষের সঙ্গে বৈঠকের পরই এনিয়ে মিডিয়ায় এক্কেবারে হৈহৈ-রৈরৈ কান্ড শুরু হয়ে গেল। ব্যাপার কী?
ব্যাপারটা যে কী, সেটা একটু খতিয়ে দেখলেই বোঝা যায়। কেননা, যে দিন চাকুরিপ্রার্থীদের সঙ্গে ব্রাত্য বসুর বৈঠক হয়েছিল সেদিনই কুণাল ঘোষ একটি কথা বলেছিলেন। আর সেই কথাটি হল – চাকরিপ্রার্থীদের নিয়োগপত্র আটকে থাকছে না কি চাকরিপ্রার্থীদের কারণেই। কেননা, চাকরির নিয়োগ নিয়ে তো মামলা চলছে! কুণাল ঘোষ সেদিন যে কথাটি বলেছিলেন সেটি তাঁর নিজের নয়। এ হল গিয়ে সরাসরি তৃণমূল নেত্রী তথা রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথা। একথা তিনি বহুবার বলেছেন। বারবার চাকরিপ্রার্থীদের মামলা মোকদ্দমা করতে মানা করেছেন। ব্রাত্য বসুর সঙ্গে বৈঠকের পর ঘুরে-ফিরে সেই কথায় শোনা গেল কুণাল ঘোষের মুখে।
এবং ওই বৈঠকের পর কুণাল আরও একটি কথা বলেছিলেন। বলেছিলেন, চাকরিপ্রার্থীদের মামলার সুযোগ নিয়ে আইনজীবীরা লাখ লাখ টাকা পকেটে পুরে নিচ্ছেন। ইঙ্গিতটা কুণাল ঘোষ কাকে করেছিলেন – সেদিনই পরিষ্কার হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু কথাটা ফাটাফাটি হল দু‘দিন পরে। যখন চাকরিপ্রার্থীদেরই একটি অংশ বিকাশরঞ্জন ভট্টাচার্যর বিরুদ্ধে ২৭ লাখ টাকা নিয়ে মামলা লড়ার দাবি জানালেন। রাজু দাস নামে এক চাকুরিপ্রার্থী কিংবা বলতে পারেন ছোটখাটো নেতা যখন মিডিয়ায় বললেন, ‘‘২০১৯ সালে বিকাশ ভট্টাচার্য আমাদের হয়ে মামলা লড়েছিলেন। তাঁর জুনিয়র দিব্যেন্দু (চট্টোপাধ্যায়) পারিশ্রমিক হিসাবে ২৭ লক্ষ টাকা নিয়েছিলেন আমাদের থেকে। শারীরশিক্ষার প্রতি শুনানিতে এক লক্ষ ২০ হাজার টাকা এবং কর্মশিক্ষার প্রতি শুনানিতে ৭০ হাজার টাকা করে দেওয়া হয়েছিল। এই টাকা জুনিয়রের হাত দিয়ে বিকাশকে দিতে হত।’’
রাজু আরও বলেছেন, ‘‘এখন যখন সরকার আমাদের চাকরির ব্যবস্থা করেছে, তখন উনি (বিকাশ) আটকাচ্ছেন। যাঁকে দিয়ে আটকাচ্ছেন সেই সোমা রায়ের সার্টিফিকেট জাল। পর্ষদ তা জানিয়েও দিয়েছে।’’ রাজুর প্রশ্ন, ‘‘উনি (বিকাশ) পারিশ্রমিক হিসাবে টাকা নিয়েছেন, ঠিক আছে। কিন্তু এখন কেন আটকাচ্ছেন? এটা তো সাপ ও ব্যাঙের গালে চুমু খাওয়া হয়ে যাচ্ছে। কোনও নৈতিকতা নেই? একবার আমাদের পক্ষে লড়লেন, এখন বিরুদ্ধে লড়ছেন?’’
এখন রাজু দাসকে কে বোঝাবে, সত্যিই যদি বিকাশরঞ্জন ভট্টাচার্য চাকরির নিয়োগ মামলা লড়তে ২৭ লাখ টাকা নিয়ে থাকেন তাহলে তাঁর নৈতিকতা থাকবে কেন? আইনজীবীরা যে সাপ এবং ব্যাঙ দুয়ের গালেই যে চুমু খান এটা কি রাজু দাস জানেন না? কিংবা জানতেন না? টাকার বিনিময়ে আইনজীবীরা মামলা লড়েন, খুনি বাঁচাতে নির্দোষকে ফাঁসান – এটা কি নতুন কথা? বিকাশরঞ্জন ভট্টাচার্য যদি তাঁর ফিজ নিয়েই থাকেন তাহলে অন্যপক্ষের ফিজ নিয়ে চাকরি সংক্রান্ত অন্য আরেকটি মামলাও লড়তে পারেন। সেটা রাজু দাসদের পক্ষে নাও হতে পারে। মোদ্দাকথা যার টাকা তার হয়েই আইনজীবী হিসেবে বিকাশরঞ্জন ভট্টাচার্য মামলা লড়বেন – এটাই তো চরম বাস্তবের কথা।
কিন্তু আসল যেটা প্রশ্ন হল, রাজু দাস এতদিনে কেন বিকাশরঞ্জন ভট্টাচার্যর টাকা নিয়ে মামলা লড়ার কথা বলছেন? এর আগে কিংবা টাকা দেওয়ার সময়ে তিনি কেন একথা ভাবেন নি? কেনই বা বিকাশরঞ্জন ভট্টাচার্যর কাছ থেকে একথা নিয়ে নেননি যে তিনি নিয়োগ সংক্রান্ত অন্যপক্ষের মামলা কোটি টাকা পেলেও লড়বেন না?
এই খেলাটা আরও জমে যায় যখন চাকরিপ্রার্থীদের আরেক পক্ষ বিকাশরঞ্জন ভট্টাচার্যকে ‘ভগবান’ তকমা দিয়ে আসরে নামে। চাকরিপ্রার্থীদের আরেক প্রতিনিধি অষ্টপদ সাসমল সংবাদ মাধ্যমে বলেন, ‘‘বিকাশবাবু টাকা নিয়েছেন, এটা ভুলভাল কথা। যাঁরা বলছেন, তাঁদের নিশ্চয় কেউ উস্কেছেন। দুর্নীতির বিরুদ্ধে বিকাশবাবু লড়ছেন। আমাদের কাছ থেকে উনি এক টাকাও নেননি। আমরা কোনও টাকা দিইনি। বরং উনি ছিলেন বলেই এত বড় দুর্নীতি প্রকাশ্যে এসেছে।’’
অষ্টপদ আরও বলেন, ‘‘আমাদের মতো গরিব ছেলেমেয়েদের পক্ষে এই মামলা লড়ার ক্ষমতাই ছিল না। কামানের সামনে মশার সমান ছিলাম আমরা। বিকাশবাবু না-থাকলে আমরা টিকতে পারতাম না। মামলা ফাইল করার সময়ে আমরা যৎসামান্য কিছু টাকা দিয়েছি বটে, তবে তা না-দিলেই নয়।’’ ওই চাকরিপ্রার্থীদের বক্তব্য, ‘‘এত বড় দুর্নীতির বিরুদ্ধে উনি লড়ছেন। অপপ্রচার, কুৎসা তো হবেই। ওঁকে সরানোর চেষ্টা চলছে। এতে আখেরে অযোগ্য প্রার্থীদের লাভ হবে। সরকারপক্ষের ইন্ধনেই এটা হচ্ছে।’’
অর্থাৎ পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে চাকরিপ্রার্থীদের মধ্যে দু‘টো ভাগ হয়ে গিয়েছে। একপক্ষ বিকাশরঞ্জন ভট্টাচার্যকে ‘টাকাখোর’ বলছে। আর অন্যপক্ষ তাঁকে ‘ভগবান’ বলছে। আর এটাই তো এতদিন ধরে চাইছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। চাকরিপ্রার্থীদের যে একজোট হয়ে দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াই সেই লড়াইয়ে ফাটল ধরাতে। এতদিন তিনি পারেননি। এবার পারছেন। ব্রাত্য বসু, কুণাল ঘোষদের সঙ্গে বৈঠকের পর সেটা সফল হচ্ছে। কুণাল ঘোষের উসকে দেওয়া পথে চাকরিপ্রার্থীদের একাংশ বিকাশরঞ্জন ভট্টাচার্যর টাকা নিয়ে প্রশ্ন তুলছে। আর অন্যপক্ষ সেটার বিরুদ্ধে কথা বলছে।
তবে বিকাশরঞ্জন ভট্টাচার্যও কম যান না। তিনিও এই বিতর্ক নিয়ে ধরি মাছ না ছুঁই পানি ধাঁচের কথা বলতে শুরু করেছেন। ‘পারিশ্রমিক গ্রহণ এবং নৈতিকতা’ বিতর্কে তিনি আত্মপক্ষ সমর্থনে বলেছেন, ‘‘সবাই জানে মক্কেলদের সঙ্গে আমার সরাসরি কথা হয়ও না, আমি সরাসরি টাকা নিইও না, নিতেও পারি না। মুশকিল হচ্ছে, জুনিয়রের মাধ্যমে তাঁরা এসেছেন, তাঁকে তাঁরা টাকা দিয়েছেন কি দেননি, তা তো আমি বলতে পারব না। আমাকে সরাসরি টাকা দিয়েছেন বলে তো তাঁরা বলতে পারছেন না, তা হলে আমার নাম জড়াচ্ছেন কেন? এটা তো পরিকল্পিত।’’
রাজ্যসভায় সিপিএম সাংসদের আরও বক্তব্য, ‘‘কে কাকে কত টাকা দিয়েছেন মামলার জন্য, তার জবাবদিহি আমি করব না। জবাবদিহি করবেন যিনি টাকা নিয়েছেন। মামলা তো আর বিনা পয়সায় হয় না। যে জুনিয়রকে টাকা দিয়েছেন ওঁরা নিশ্চয়ই দেখিয়েছেন যে কত টাকা লাগতে পারে!’’
ওহো কী দারুন! তিনি চাকরিপ্রার্থীদের মামলা টাকা নিয়ে লড়ছেন না কি বিনাপয়সায়, সেটা বিকাশরঞ্জন ভট্টাচার্য নিজেই জানেন না। যা জানে সব ওই জুনিয়র। অতএব এও দেখে নেওয়া যাক জুনিয়র কী বলছেন। বিকাশরঞ্জন ভট্টাচার্যর জুনিয়র দিব্যেন্দু সংবাদ মাধ্যমকে বলেছেন, ‘‘শুনানিতে স্যার এবং আমরা থাকলে যে ফিজ হয়, তা-ই নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু সেটা যে ২৭ লক্ষ টাকা কি না সেটা আমি বলতে পারব না। আমরা এককালীন কোনও টাকা নিই না।’’
মোদ্দাকথা হল, বিকাশরঞ্জন ভট্টাচার্য নিয়োগ মামলায় টাকা নিয়েছেন। কিন্তু কতটাকা নিয়েছেন সেটা স্পষ্ট নয়। তাঁর জুনিয়র স্বীকার করেছেন ফিজ নেওয়া হয়েছিল। এখন বিকাশরঞ্জন ভট্টাচার্যর ফিজ যদি প্রতি মামলার শুনানিতে হাজির থাকার জন্য ১ লাখ টাকার ওপর হয় – তাহলে টাকার অঙ্ক ২৭ লাখ টাকা হতেই পারে। কিন্তু জুনিয়র বলছেন, সেটা এককালীন নেওয়া হয়নি। এককালীন দেওয়া হয়েছে, এটা বিকাশরঞ্জন ভট্টাচার্যর বিরোধীপক্ষও দাবি করছে না। কিন্তু বিকাশরঞ্জন ভট্টাচার্যর পকেটে সেই টাকা দফায় দফায় হলেও গিয়েছে কি না সেটা বিকাশরঞ্জন ভট্টাচার্য স্বীকার করছেন না।
বদলে তিনি তৃণমূলের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের তত্ত্ব আউরাতে শুরু করে দিয়েছেন। বলেছেন, ‘‘এঁদের তো দল বেঁধে আমার বাড়িতে পাঠিয়েছিল তৃণমূল। বাড়ি ঘেরাওয়ের চেষ্টা করেছিল। একই দলকে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়ের বাড়িতে। ওরা চাইছে সমস্ত প্রক্রিয়াটাকে দুর্নীতির মধ্যে দিয়ে কার্যকরী করা হোক। সেটাই শিখিয়ে পাঠানো হয়েছিল।’’ বিকাশের দাবি, গোটাটাই রাজনৈতিক অভিসন্ধি নিয়ে করা হচ্ছে। সিপিএম সাংসদ বলেন, ‘‘এর আগে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছিলেন আমার নামে ফাইল খুলবেন। পেরেছেন কি? এটাও ওদের কাছে ব্যুমেরাং হবে।’’
একথা লেখার পর শুধু এটুকুই যোগ করব, ফিজ নিয়ে কারও মামলা লড়ে বিকাশরঞ্জন ভট্টাচার্য কোনও অনৈতিক কাজ করেননি। কিন্তু তিনি যে ‘ভগবান’ নন, সেটা খোলসা করেও বলতে চাইছেন না। উলটো দিকে এই বিতর্কে আসল প্রশ্নটাই চাপা পড়ে যাচ্ছে যে যোগ্য চাকরিপ্রার্থীরা চাকরি পাবেন কি না? পেলে কবে পাবেন? কবে রাজ্য সরকার তাঁদের চাকরিতে বহাল করবে? আর এই যে এত বিতর্ক তাতে ঘুরে ফিরে কার লাভ হচ্ছে? অবশ্যই সরকারের। তৃণমূলের। বিকাশরঞ্জন ভট্টাচার্য টাকা নিয়ে মামলা লড়েছেন কি না – এই বিতর্কের জেরে যদি চাকরিপ্রার্থীদের মধ্যে ভেদাভেদ শুরু হয়, আন্দোলনে যদি ফাটল ধরে তাহলে চাকরি প্রার্থীরা চাকরি পান বা না পান – তৃণমূল সরকারের অন্তত মাথাব্যথা কমবে। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় অন্তত একটু স্বস্তির শ্বাস ফেলতে পারবেন। আর সেটা করতেই তো ব্রাত্য বসু, কুণাল ঘোষরা চাকরি প্রার্থীদের সঙ্গে বৈঠকে বসেছিলেন। সেটাই এখন হচ্ছে।
শেষে এই কথা না বললেই নয়, চাকরিপ্রার্থীদেরও বাহবা না দিয়ে পারা যায় না। এঁরা যেভাবে আন্দোলনের মাঝেই চাকরির জন্য মুখ্যমন্ত্রীর পা ধরার জন্য মুখিয়ে থাকেন, চাকরির নিয়োগপত্র হাতে পাওয়ামাত্রই ঘরে চলে যাওয়ার কথা বলেন – তাতে সন্দেহ হয় আদৌ এঁরা শিক্ষাক্ষেত্রে দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নেমেছে তো? না কি লড়াইয়ের নামে নামে ভিড় জমিয়ে নিজের নিজের স্বার্থসিদ্ধিই এঁদের একমাত্র উদ্দেশ্য? এই প্রশ্নটাও কিন্তু উঠছে।
(প্রবন্ধের বক্তব্য একান্তই লেখকের নিজস্ব)