Homeখবরইডি-সিবিআই-এর ‘পাঁচভুল’, যে কারণে আত্মবিশ্বাসী অভিষেক, হতাশ শুভেন্দু

ইডি-সিবিআই-এর ‘পাঁচভুল’, যে কারণে আত্মবিশ্বাসী অভিষেক, হতাশ শুভেন্দু

- Advertisement -

তথাগত সিংহ

বাজি কি উলটে গেল? তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় যখন চোখের ডাক্তার দেখাতে বিদেশে যেতে চেয়েছিলেন, সোশাল মিডিয়ার একাংশ হাওয়া তুলেছিল – এ নির্ঘাত দেশ ছেড়ে পালানোর চেষ্টা। গ্রেফতারির আগে বিদেশে গিয়ে লুকোনোর চেষ্টা। এরপর তিনি যখন দুবাই হয়ে আমেরিকায় গেলেন, সোশাল মিডিয়ার জল্পনা তৈরি হল – এবার নির্ঘাত গণেশ উল্টোবে। ‘ভাইপো’ দুবাইয়ে গিয়ে ‘কালোটাকা’ নাড়াচাড়া করবেন। আর সেটা ধরতেই তাঁকে দুবাই-আমেরিকা যাত্রার ছাড়পত্র দিয়েছে ইডি। এরপর ইডির সূত্র মারফত সংবাদ মাধ্যমে যখন ‘ভাইপো’র বিদেশী বান্ধবীর ‘গল্প’ বেরোল তখন অনেকে প্রায় ধরেই নিলেন – এ যাত্রায় অভিষেকের রক্ষা বুঝি আর হল না!

কিন্তু অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় যখন বিদেশ থেকে দেশে ফিরে এলেন, দেখা গেল পুরো খেলাটাই অনেকটা ঘুরে গিয়েছে। অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়কে গ্রেফতার করা দূর, জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ডাকতেও ইতস্তত করছে ইডি। এরপর আচমকাই একদিন ‘লিপস অ্যান্ড বাউন্ডস’ কোম্পানীতে রেড পড়ল। আর এতেই অভিষেককে প্রাইমারি শিক্ষক দুর্নীতি মামলাতে ইডির যে ঘিরে ধরার চেষ্টা সেটা আইনি প্যাচে ফেঁসে গেল। কলকাতা হাই কোর্টের বিচারপতি তীর্থঙ্কর ঘোষ সোজা জানিয়ে দিলেন, ‘লিপস অ্যান্ড বাউন্ডস’ কোম্পানিতে রেড করার সময় ইডির এক তদন্তকারী আধিকারিক যে ১৬টি ফাইল ডাউনলোড করেছে তাতে কী রয়েছে সেটা জেনেই তিনি অভিষেকের রক্ষাকবচ মামলায় রায় দেবেন। ততদিন পর্যন্ত অভিষেকের বিরুদ্ধে ইডির কোনও কড়া পদক্ষেপ তিনি চান না। ব্যাস, ফ্রন্টফুট থেকে ইডি এক্কেবারে ব্যাকফুটে চলে এল। রাজ্যের বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী তো বলেই ফেললেন, ‘‘ইডির ডাকাডাকির ওপর আমার আর কোনও ভরসা নেই।’’

এখন কথা হচ্ছে, ইডি এমন আচমকা এমন ব্যাকফুটে চলে এল কেন? এর উত্তরে পাঁচটি যুক্তি হয়তো দেওয়া যায়। আর যুক্তিগুলি হল –

১। নিয়োগ মামলায় যে কালীঘাটের কাকু ওরফে সুজয়কৃষ্ণ ভদ্রকে সামনে রেখে ইডি অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে ঘুটি সাজাতে চাইছে – তাঁকে মোটেও বাগে আনা যাচ্ছে না। মানে সুজয়কৃষ্ণ ভদ্রকে কাস্টোডি নিয়েও এমন কোনও স্বীকারোক্তি করানো যাচ্ছে না যাতে প্রমাণ হয় অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে কালীঘাটের কাকুর গোপন লেন-দেনের সম্পর্ক রয়েছে।

অথচ এই সুজয়কৃষ্ণ ভদ্রই ইডির হাতে গ্রেফতার হওয়ার আগে মিডিয়ার ক্যামেরায় বয়ান দিয়ে রেখেছে – অভিষেকই আসলে তাঁর বস। কিন্তু ইডির জিজ্ঞাসাবাদের মুখে তিনি পালটি মেরে বসে আছেন। উলটে নিজের শারীরিক পরিস্থিতির দোহাই দিয়ে দিনের পর দিন সময় কাটাচ্ছেন। আর এই কারণেই হয়তো মরিয়া হয়ে ইডির তদন্তকারী আধিকারিকরা মাঝখানে ‘লিপস অ্যান্ড বাউন্ডস’ কোম্পানিতে হানা দিয়েছিল। কিন্তু তাতে হল গিয়ে উলটো।


২। ইডির ব্যাকফুটে চলে যাওয়ার পিছনে সবথেকে বড় কারণ এই ‘লিপস অ্যান্ড বাউন্ডস’ কোম্পানির ১৬টি ব্যক্তিগত ফাইল ডাউনলোড। এনিয়ে যদি বিতর্কের জেরে যদি আইনি জটিলতা না হতো তাহলে ইডি হয়তো এখনো আগ বাড়িয়েই ব্যাটিং করত। কিন্তু আদালতে গিয়ে এনিয়ে জবাব দিতে গিয়ে ইডি পড়েছে মহা মুশকিলে। মেয়ে কোন ডাক্তারি কলেজে পড়বে সেটার খোঁজ করার জন্য নিশ্চয় ইডির কোনও তদন্তকারী আধিকারীকের ‘লিপস অ্যান্ড বাউন্ডস’ কোম্পানিতে যাওয়ার প্রয়োজন নেই। ইডি যতই যুক্তি দেওয়ার চেষ্টা করুক যে ‘লিপস অ্যান্ড বাউন্ডস’এর ইন্টার স্পীড খুব ভালো ছিল বলেই ছাপামারির দিন ইডির এক আধিকারিক এই ডাউনলোডের কাজটা করেছিলেন – এটা কারও জন্য বিশ্বাসযোগ্য হতে পারে না। হাই কোর্টের বিচারপতি তীর্থঙ্কর ঘোষের জন্য তো নয়-ই। সুতরাং জবাব তলব হয়েছে। ওই ফাইলগুলিতে কী রয়েছে জানতে আদালতের তরফে রিপোর্ট চাওয়া হয়েছে।

৩। এতবড় একটা মারাত্মক ‘ভুলে’র পর ইডির দিকে আরও একটা প্রশ্ন ওঠে – আচমকাই ওই ফাইল ডাউনলোড করা আধিকারিককে অন্য জায়গায় বদলি করা হল কেন? কেন তাঁকে কলকাতা সরিয়ে গুয়াহাটি পাঠিয়ে দেওয়া হল? তাও আবার তখন, যখন তাঁর ফাইল ডাউনলোড নিয়ে বিতর্ক তৈরি হল? ইডি এর যুক্তিতে নিয়মমাফিক বদলির তত্ত্ব খাড়া করেছে। কিন্তু সেই যুক্তি কোথাও ধোপে টেকেনি। বরং তৃণমূলের জন্য সেটা হাতিয়ার হয়ে দাঁড়িয়েছে। অভিষেকপন্থীরা বলার সুযোগ পেয়ে গিয়েছেন, ইডির তদন্তকারী আধিকারিকরা তলে তলে ‘অন্য খেলা’ খেলছে।  

৪। আরেকটা বিষয় হল – ইডি কিংবা সিবিআইয়ের তদন্ত দীর্ঘদিন ধরে চলে। আমাদের দেশে যে কোনও তদন্তের ক্ষেত্রেই আঠারো মাসে বছর হয়। এতে রাজনৈতিক ফায়দাও প্রচুর হয়। তাই আদালত যখন পশ্চিমবঙ্গের তৃণমূল সরকারের বিরুদ্ধে একের পর এক সিবিআই কিংবা ইডির তদন্তের আদেশ দিয়েছিল তখন বারবার তদন্তকারী আধিকারিকদের এই সময়ের ব্যাপারটা মনে করিয়ে দিয়েছিল।

কিন্তু যতদিন গিয়েছে, ইডি কিংবা সিবিআইয়ের তদন্তকারী আধিকারিকদের আদালতের ভর্ৎসনার মুখ পড়তে হয়েছে। তদন্তের গতি-প্রকৃতি নিয়ে আদালত বারবার প্রশ্ন তুলেছে। কিন্তু তাতে ইডির তদন্তে তেমন গতি আসেনি। এরজন্য আধিকারিকদের সংখ্যা দায়ী হতে পারে। আদালত কিংবা সাধারণ মানুষ যে গতিতে তদন্ত চায় তা করতে হলে যে সংখ্যাক আধিকারিক দরকার তা ইডি সিবিআইয়ের নেই। ফলে তদন্তে দেরি হওয়ায় স্বাভাবিক। এই পরিস্থিতিতে তদন্তের গতি নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। অন্যদিকে আদালতের ঠ্যালায় পড়ে ইডি দৌঁড়তে গিয়ে হোঁচট খেয়ে পড়ছে।

ফলে দুর্নীতির মাথাদের ধরতে ইডি কিংবা সিবিআইয়ের তদন্তকারী আধিকারিক যে রণকৌশল নিচ্ছে তা অনেক সময় ব্যর্থ হয়ে যাচ্ছে। আর যাই হোক, অপরপক্ষ তো আর চুপ করে বসে নেই। তাঁরাও পালটা চাল দিচ্ছে। ফলে অফিসারদের অভাবে জাল থেকে মাছ বেরিয়ে যাচ্ছে।

৫। তবে সবশেষে রাজনৈতিক চাপের কথা না বললেই নয়। ইডি-সিবিআইকে সাধারণত সেই সব তদন্তই করতে হয় যেগুলির সঙ্গে রাজনীতির যোগ রয়েছে। শাসক-বিরোধীর লড়াই রয়েছে। এরফলে তদন্ত করতে গিয়ে আধিকারিকদের কীরকম চাপের মুখে পড়তে হয় সেটা বলাইবাহুল্য। আর তাতে যদি হাই কোর্ট কিংবা সুপ্রিম কোর্ট ঢুকে পড়ে তাহলে তো কথাই নেই। কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থার আধিকারিকদের স্যান্ডউইচ হয়ে যেতে হয়। ফলে যে ধীরতার সঙ্গে তদন্তগুলি করার প্রয়োজন হয় তা অনেক সময়ই ইডি কিংবা সিবিআইয়ের আধিকারিকরা পান না।

আর যদি কোনও তদন্তের ক্ষেত্রে শাসক ও বিরোধী দুই রাজনৈতিক দলের মধ্যে নেতা অদল-বদল হয়ে থাকে তাহলে রহস্যের জট মাকড়সার জালকেও হার মানিয়ে দেয়। যেমনটা কি না পশ্চিমবঙ্গের ক্ষেত্রে হয়েছে। এখানে তৃণমূল ও বিজেপির মধ্যে বহু নেতাই দলবদল করেছেন। এই পরিস্থিতিতে কার আমলে কী হয়েছে, কোন দুর্নীতিতে কে ধোয়া তুলসীপাতা সেটা প্রমাণ করতে হলে ইডি-সিবিআইকে অনেক কাঠ-খড় পোড়াতে হবে। যে কারণে নিয়োগ দুর্নীতি কিংবা কয়লাপাচার দুর্নীতির অবস্থা সারদা-নারদার মতো হয়ে যেতে পারে।

এই পরিস্থিতিতে দুর্নীতির মাথাদের ধরতে সময় তো লাগবেই।   

- Advertisement -
- Advertisement -
- Advertisement -
- Advertisement -