Homeবৈঠকবয়স্ক তৃণমূলিদের অবসর নিয়ে অনড় অভিষেক, পিসির কথা শুনতে নারাজ ভাইপো

বয়স্ক তৃণমূলিদের অবসর নিয়ে অনড় অভিষেক, পিসির কথা শুনতে নারাজ ভাইপো

- Advertisement -

তথাগত সিংহ

একটা লম্বা সময়ের পর মুখ খুললেন অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। কিন্তু মুখ খুলেই যা বললেন, সেটা নিশ্চয় তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভালো লাগবে না। আরও বেশি ভালো লাগবে না সেই সব নেতাদের যাঁরা তৃণমূলে নবীনদের জায়গা ছেড়ে দিতে নারাজ। সৌগত রায়, সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়দের মতো নেতাদের মনোভাব হল – মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দয়ায় করে কম্মে খাচ্ছেন – যত দিন চলে ততদিনই মঙ্গল। কিন্তু মাঝখান থেকে অভিষেক নতুন ছক কষেছেন। নতুনদের জায়গা করে দিতে (নিজের লোকেদের ক্ষমতার অলিন্দে ঠাঁই দিতে) বয়সের কথা বলছেন। আর এ নিয়েই এখন তৃণমূলে যত তর্ক-বিতর্ক।

অনেকেই মনে করেছিলেন, অভিষেক যখন চুপ করে আছেন – তাহলে হয়তো ব্যাপারটা মিটে গিয়েছে। একটা সমঝোতায় হয়তো আসা গিয়েছে। কিন্তু রবিবার ডায়মন্ড হারবারের পৈলানে বার্ধক্যভাতা বিতরণ করতে গিয়ে অভিষেক যা বললেন, তাতে তৃণমূলের বয়স্ক নেতা-নেত্রীরা নিশ্চয় রাতে ভালোমত ঘুমোতে পারবেন না। রাতে ভালোমত ঘুম আসবে না আরও একজনের। আর তিনি হলেন স্বয়ং মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।

তৃণমূলে নবীন-প্রবীণদের জায়গা কেমন হবে, সেনিয়ে আগেই ব্যাখ্যা দিয়েছেন মমতা। নিজেই জানিয়েছেন, পুরনো চাল ভাতে বাড়ে। কিন্তু অভিষেক এদিন বললেন, বয়স হলে ক্ষমতা কমে। এক্কেবারে উলটো কথা। কালীঘাটে ডেকে বেশ করে বুঝিয়েও যে মমতা অভিষেকের মন পালটাতে পারেন নি, সেটা ডায়মন্ড হারবারে বুঝিয়ে দিলেন অভিষেক। বরং উলটে উদাহরণ দিয়ে বললেন, ‘‘আমার ৩৬ বছর বয়স বলে রাস্তায় পড়ে তৃণমূলের নবজোয়ার করতে পেরেছি। এই কাজটাই যদি দিলীপদাকে বলা হতো (বিজেপির দিলীপ ঘোষ নন, ইনি ডায়মন্ড হারবারের বয়স্ক তৃণমূল নেতা) তিনি সেটা হয়তো দলের নির্দেশ মেনে করতেন। কিন্তু অসুবিধা হতো। অনেক সমস্যা হতো। কিন্তু সেই কাজটাই যদি কোনও কমবয়সী ছেলে করে সমস্যা কম হবে। অসুবিধা কম হবে।’’

এতটুকুতেই থেমে থাকেন নি অভিষেক। বয়সের খোঁটা দিয়ে একথাও বলেছেন, ‘‘৬০ বছর বয়স হয়ে গেলে পরিশ্রম করার ক্ষমতা কমে যায়।’’ এখানে মনে রাখবেন খোদ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় দিন কয়েকের মধ্যে ৬০ কোঠায় পা দিতে চলেছেন কিংবা দিয়ে ফেলেছেন। যদি না প্রাইমারি স্কুলের হেড স্যার কোন কারিকুরি করে থাকে। তাহলে অভিষেক মমতাকেই ঘুরিয়ে বয়সের খোঁটাটা দিয়ে বসলেন না তো? তৃণমূলের নেতা কর্মীরা একটু ভেবে দেখবেন।

সৌগত রায়ের মতো তৃণমূলের বয়স্ক নেতাদের পরিস্কার কথা, ‘‘৭০ বছর বয়স হয়ে গেলে বসে যেতে হবে, বিজেপির মতো নিয়ম তৃণমূল তো এখনও করেনি। সুতরাং প্রবীণদের নিয়ে তৃণমূলে আপত্তি কোথায়?’’ প্রায় একই সুর শোনা গিয়েছে সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায় কিংবা সুব্রত বক্সীদের মতো মমতাপন্থীদের কথায়। সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায় তো জনসভাতেই বলেছেন, ‘‘মমতা না থাকলে বাংলা ছাগলের তৃতীয় বাচ্চা হয়ে যাবে। দিল্লিতে পশ্চিমবঙ্গকে নিয়ে যতটুকু তর্ক-বিতর্ক হয়, সবটাই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের জন্যে।’’ গোদা বাংলায়, অভিষেকের পক্ষে দিল্লি সামাল দেওয়া সম্ভব নয়।

সুব্রত বক্সী তো আবার এক কথা বলতে গিয়ে আরেক কথা বলে ফেলেছেন। অভিষেকের ২০২৪-এ নেতৃত্ব দেওয়া নিয়ে প্রশ্ন করতে গিয়ে বেচারার মুখ দিয়ে বেরিয়ে গিয়েছে, ‘‘আশাকরি ২০২৪-এ অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় পালিয়ে যাবেন না। তিনি নিশ্চয় আমাদের নেতৃত্ব দেবেন।’’ শোনো কথা! যাঁর হাতে দিদি দলের হাল তুলে দেওয়ার ব্যবস্থা করছেন – তাঁকেই কি না বলছেন, ‘আশাকরি পালিয়ে যাবেন না।’’ বোঝো ঠ্যালা।

তো এতকিছুর পর মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় অভিষেককে কালীঘাটের বাড়িতে ডাকলেন। ঘণ্টা খানেকের বেশি বৈঠকও হল। অন্যদিকে, তৃণমূলের মাঝারি, ছোট নেতারাও ধীরে ধীরে মুখে কুঁলুপ দেওয়া শুরু করলেন। তৃণমূলের মুখপাত্র কুণাল ঘোষও ঘোষণা করলেন, মমতা-অভিষেক আসলে বর্তমান আর ভবিষ্যৎ। একজন সুষ্ঠভাবে দল চালাচ্ছেন। অন্যজন ভবিষ্যতে চালাবেন। অতএব গল্প শেষ

কিন্তু ওই যে রবী ঠাকুর বলে গিয়েছেন – গল্প মানেই হচ্ছে যা শেষ হইয়াও হইল না শেষ – সেই রকমই তৃণমূলের গল্প শেষ হল না। নতুন করে সেই গল্পে লাইন জুড়ে দিলেন খোদ তৃণমূলের নাম্বার টু অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। ডায়মন্ড হারবার থেকে প্রশ্ন ছুড়লেন, ‘‘আমি ভুল কি বলেছি? যা বাস্তব সেটাই বলেছি।’’ তবে শাক দিয়ে মাছ ঢাকার মতোই আবার ভাষণে এই কথাগুলোও জুড়ে দিলেন, ‘‘তৃণমূল ঐক্যবদ্ধভাবেই ২০২৪এর লোকসভা নির্বাচন লড়বে। কোনও নতুন পুরনোর দ্বন্দ্ব নেই। এসব নিয়ে বাজার গরম করার কোনও মানে নেই। দলের একমাত্র নেত্রী হিসেবে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আমাকে যা দায়িত্ব দেবেন, যে কাজ দেবেন, যা করতে বলবেন – করব।’’ কিন্তু এই কথাগুলো একটু অভিমানের মতো শোনাল না?

তবে তৃণমূলের নবীন-প্রবীণ দ্বন্দ্বের মাঝেই এদিন আরও একটি বিতর্ক তৈরি হয়ে গেল। আর সেই বিতর্কটাও তৈরি করলেন স্বয়ং অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। বলতে গেলে আগামীদিনে নবীন-প্রবীণ দ্বন্দ্বের থেকে এই বিতর্কটাই বেশি হাওয়া ধরবে। অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় এদিন ৭৬ হাজারেরও বেশি ষাটোর্ধ মানুষের জন্য বার্ধক্যভাতার ব্যবস্থা করলেন। আজীবন এই মানুষগুলিকে মাসে হাজার টাকা করে দেওয়া হবে। এরজন্য না না করে প্রতিমাসে ৭ কোটি টাকা করে খরচ হবে। কিন্তু সেই টাকা রাজ্যের তৃণমূল সরকারের নয়। তৃণমূলেরও নয়। তাহলে কার টাকা? এই প্রশ্নটাই তুলছেন বিরোধীরা। শুভেন্দু অধিকারীরা।

অভিষেক যদিও বলেছেন, এই টাকা আসলে ১৬ হাজার ৩০০ জন স্বেচ্ছাসেবকের। এক এক জন স্বেচ্ছাসেবক ৪ থেকে ৫ জনের বার্ধক্যভাতার দায় নিয়েছেন। ডায়মন্ড হারবার মডেল বলে কথা। অভিষেক তাঁর লোকসভা কেন্দ্রে এটা করে দেখালেন। কিন্তু এখানেই থেমে না থেকে অভিষেক আরও যেটা বলেছেন সেটাই এখন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মাথাব্যথা। বলেছেন, রাজ্য সরকারও আগামীদিনে এই ব্যবস্থা করবে। এটা মানবিকতার খাতিরে করা উচিত। এমনিতেই রাজ্যের ভাঁড়ে মা ভবানী অবস্থা। টাকার অভাবে ভাঙা রাস্তা সারানো ছাড়া সব উন্নয়নের কাজ আপাতত থমকে। তাও আবার সেই কাজ তৃণমূল নেতাদের করতে হচ্ছে নিজের গাঁট থেকে। এই পরিস্থিতিতে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ডায়মন্ড হারবার মডেলের কথা শুনলে অন্য তৃণমূল নেতাদের নিশ্চয় কাঁপুনি দিয়ে জ্বর আসবে।

আর যদি ধরে নেওয়ায় যায়, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে এই কাজ কিছুদিনের মধ্যে শুরু করবেন, তাহলেও প্রশ্ন উঠছে টাকা আসবে কোত্থেকে? অভিষেক তো বলেই খালাস। কিন্তু এখানেই বিতর্ক থামছে না। বরং প্রশ্ন উঠছে, এতদিন তাহলে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় করেছেনটা কী? তিনি তো দাবি করেছেন, বাংলার মানুষের সব কাজই না কি করে বসে আছেন। তাহলে বার্ধক্যভাতা কোথায়? তার থেকেও বড় প্রশ্ন অভিষেককে তাহলে ভুলটা ধরিয়ে দিতে হচ্ছে। অভিষেক ১৪ বছরের তৃণমূল সরকারের খামতিটা তাহলে ঠিকই জানেন। অতএব মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের থেকে অভিষেক কি তাহলে বেশি দক্ষ প্রশাসক?

ব্যস ঘুরে-ফিরে যেখানে আমরা শুরু করেছিলাম, সেখানেই ফিরে এলাম। অভিষেক এভাবে বার্ধক্যভাতা দিয়ে মমতার খামতি ধরিয়ে দিয়ে নিজের যোগ্যতার প্রমাণ দিচ্ছেন না তো? কিসের যোগ্যতা? কেন একজন দক্ষ প্রশাসকের? ডায়মন্ড হারবার মডেলকে যেভাবে তিনি বাংলার মডেল বানানোর চেষ্টা করছেন তাতে অভিষেক মমতাকে ঘুরিয়ে এটা বলছেন না তো – এবার চেয়ারটা ছাড়ুন তো দেখি। আপনার বয়স হয়েছে। কর্মক্ষমতা কমে গিয়েছে। কাজে খামতি থেকে যাচ্ছে। বয়সের কারণেই এটা হচ্ছে। আমাকে দায়িত্ব দিন। সব ঠিক করে দেব।

অতএব ব্যাপারটা সেই ঘুরে ফিরে নবীন-প্রবীণের দ্বন্দ্ব হয়ে গেল না তো? যে দ্বন্দ্বে নবীন হচ্ছেন স্বয়ং অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় এবং প্রবীণ হচ্ছেন মমতা।

- Advertisement -
- Advertisement -
- Advertisement -
- Advertisement -